অণুগল্প

অনুতপ্ত অনুভব || শাহরিয়ার সোলায়মান

বুড়ি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে এক সমুদ্র বিস্ময় চোখে। আমি তাকিয়ে আছি বুড়ির লজ্জামাখা কাঁজল রাঙানো চেখের পানে। অবশ্য এই মুহূর্তে ওর চোখে লজ্জাবতীর রূপ ফিকে হয়ে এসেছে। কিছুটা সংশয়.! চোখের জলে চশমাটা ঝাপসা হয়ে গেছে। ভারী ফ্রেমের চশমাটা চোখ থেকে নামাতেই দৃশ্যমান হয় ফোটা ফোটা জল। সে জল দেখে আমি দিশেহারা হয়ে যাই.!

লজ্জাবতীকে আমি ভুল ক্রমে কষ্ট দিয়ে ফেললাম নাতো.! সেই প্রথম বয়সে যখন নিজের অজান্তেই লজ্জাবতীকে কষ্ট দিয়েছিলাম সে কথা মনে পড়লেই বুকের ভিতরটা ধুক ধুক করে কেঁপে ওঠে। ঠুনকো একটা বিষয়ে লজ্জাবতী যে এতোটা অভিমান করবে আমি ভাবতেই পারিনি। ওর অভিমান ভাঙাতে আমার দীর্ঘ ১৫ দিন সময় লেগেছিল। অভিমানের কারণ জানতে পেরে মনে মনে হেসেছিলাম খুব। এত সামান্য বিষয়ে কেউ অভিমানী হতে পারে জানা ছিলোনা। পরক্ষণেই মনে প্রশ্ন জেগেছিলো এই রাগের কারণ কী.!

লজ্জাবতী তাকিয়ে আছে অশ্রুজলে ডোবা মায়াবী চোখে। আমি মনে সংশয়,ভয়,আর ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন করি। তুমি কাঁদছো কেনো? তোমার কান্নায় আমি যে ভেসে যাই। তুমি কাঁদবে না। তোমার চোখের প্রত্যেক ফোটা জল আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। লজ্জাবতী দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে। খুব শক্ত করে দু’হাতে আমায় আপন করে নেয়। চোখের নোনা জলে আমি ভিজে যাই। ভিজে যায় আমার মন.! ও মাথা উঠায়। নরম ক্লেস দু’হাতে আমার গাল ধরে। তারপর বলে,”সুলতান তুমি আমায় ক্ষমা করো”। তোমায় আমি কষ্ট দিয়েছি, বুক ভরা কষ্ট নিয়ে তুমি আমায় ভালোবাসা দিয়েছ। দিয়েছ এক পৃথিবী সুখ। তার বদলে তোমায় আমি যে কষ্ট দিয়েছি সে কষ্ট কখনই ক্ষমার যোগ্য নয়। ওর বৃদ্ধ কাঁপা কন্ঠে আমি শংকিত ভাঙা শব্দে বলি তুমি আমায় যা দিয়েছ সে বুঝি আমার প্রাপ্যের বাইরের পাওনা ছিলো। তুমি আমায় কষ্ট দিতে যাবে কেন? তোমার বিন্দু বিন্দু ভালোবাসাটুকু আমার বিশাল আকাশের সুখ।

লজ্জাবতী কিছুটা নরম কন্ঠে বলে। তুমি যখন আমায় প্রথম ভালোবাসি বলেছিলে তখন আমার খুব রাগ হয়েছিল আবার অনেকটা খুশিও হয়েছিলাম। তোমার আবেগের উপর আমার খুব রাগ হত। এতো পিচ্চি একটা ছেলে আবার ভালোবাসতে পারে.! ভালোবাসার মানে বোঝে ও.! মুখে আসলো আর বলে দিলো ভালোবাসি.! Immature মনে হয়েছিলো তোমাকে। তারপরও যখন তুমি বার বার আমায় বুঝাতে চাইতে আমায় ছাড়া তোমার চলবেনা তখন মন তোমার ভালোবাসায় গলতে চাইলেও নিজেকে শক্ত করে রাখি পরিবারের ভয়ে। এরপর আমার উপেক্ষায় হঠাৎ করেই দীর্ঘ সময়ের জন্য তুমি সরে গেলে। বিশ্বাস করো প্রতি মুহূর্তেই তোমার জন্য এক হাহাকার হৃদয়ে বয়ে বেড়াতে হত। তোমায় আমি পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলাম তুমি কি সত্যি আমাকে ভালোবাসো কিনা.! সে পরীক্ষায় আমি হেরে যাই, তোমায় হারিয়ে বসি। বাবা হঠাৎ করেই আমার বিয়ে দিয়ে দেয়। বাবার মতের বিরুদ্ধে না করতে পারিনি।

আমার স্বামীর বিশাল বাড়ি ছিলো, ছিলো বিলাস বহুল গাড়ী। কিন্তু সুখ ছিলোনা। লেট নাইট পার্টি করে এসে ও ঘুমিয়ে পড়তো। আমি মৃত মানুষের মত রাতভর কান্না করতাম।
লজ্জাবতীর কথা শুনে বুকটা অসার হয়ে আসছিলো। শরীরের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। ওর ঠোঁটে হাত দিয়ে ওকে থামিয়ে দেই। আমি বলি, তোমায় আর কষ্ট পেতে দেবো না। আমি তো আছি। তোমার মুখে কষ্টের কথা শুনলে আমার হৃদ স্পন্দন থেমে যায়। জীবনের শেষ মুহূর্তটা তোমায় সুখী দেখতে চাই। তোমার লজ্জামাখা মুখটা দেখতে দেখতে মরতে চাই। তোমার কোল জুড়ে কেবল আমি থাকতে চাই। অসুখের ছায়া তোমায় ভুল করেও ছুঁতে পারবেনা। লজ্জাবতীকে বুকে টেনে নেই। সেই মন মাতানো ঘ্রাণে নাক ডুবিয়ে দেই। ভালোবাসার অন্তিম সুখ অনুভব করি। ও কিছুটা লজ্জা কন্ঠে বলে বুড়ো বয়সের ভিমরতি। ভিমরতি তেই ভালোবাসার সুখ.!

লাবিবা, আর রাতিন দরজার আঁড়ালে দাঁড়িয়ে বলে দাদু দাদু দেখে ফেলেছি। তুমি দাদীকে ইয়ে করছিলে। আমাদেরও শিখাওনা কিভাবে ইয়ে করতে হয়?
বুড়ো বয়সে লজ্জাবতী ১৯ বছরের যুবতীর মত লজ্জা পেয়ে বসে। আমি মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে ওর লজ্জাময়ী মুখখানি দেখি। ততক্ষণে লজ্জাবতী নাতীদের পিছে পিছে দৌঁড়ানো শুরু করে দিয়েছে। লাঠি হাতে লজ্জাবতী। খুব পাকনা হয়েছ তোমরা। আয় তোদের ইয়ে শেখাবো আজ খুব করে। আয়, কাছে আয় বলছি। একদম পালানোর চেষ্টা করবিনা…