আজাদ ছিল তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ইস্কাটনে কয়েক বিঘা জমিতে ছিল তাদের রাজকীয় বাড়ি। আজাদ সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। আজাদের বাবা আরেকটা বিয়ে করলেন। আজাদের মা প্রতিবাদ করলেন। সিক্সে পড়া ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন স্বামীর প্রাসাদ থেকে। আশ্রয় নিলেন বস্তিঘরে। অনেক কষ্ট করে ছেলেকে লেখাপড়া করালেন। ১৯৭১ সালে আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করল। আজাদের বন্ধু ছিল জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী, কাজী কামাল, হাবিবুল আলম প্রমুখ। এরা সবাই আগরতলায় গিয়ে মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ নিয়ে ঢাকা শহরে ফিরে এসে গেরিলা অভিযান চালাচ্ছে। একের পর এক অভিযানে ঢাকা শহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তখন তটস্থ।
আজাদ বলল, এ জগতে মা ছাড়া আমার কেউ নাই, মায়েরও আমি ছাড়া আর কেউ নাই। মা যদি আমাকে অনুমতি দেন, তাহলেই কেবল আমি যুদ্ধে যেতে পারি।
আজাদের সঙ্গে দেখা হলো মুক্তিযোদ্ধা বাস্কেটবল খেলোয়াড় কাজী কামালের। কামাল বললেন, চল, অপারেশনে চল। তুই তো তোর বাপের বন্দুক চালাইতে পারস।
মা তাকে অনুমতি দিলেন। আজাদের ট্রেনিং ছিল না, তা সত্ত্বেও সে গেরিলা বন্ধুদের সহযাত্রী হয়ে দুটো অপারেশনে যোগ দিয়েছিল। আজাদদের বাড়ি হয়ে উঠল মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের ক্যাম্প। সেখানে এসে উঠলেন জুয়েল, ক্রিকেটার জুয়েল, আজাদ বয়েজে খেলতেন, মারকুটে ব্যাটসম্যান আর উইকেটকিপার ছিলেন। উঠলেন কাজী কামাল। সেখানে থাকতেন মর্নিং নিউজ-এর সাংবাদিক আবুল বাশার। তাঁদের বাড়িতে অস্ত্র, গোলাবারুদ মজুত করা হলো।
১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট ঢাকা শহরের অনেকগুলো মুক্তিযোদ্ধানিবাসে পাকিস্তানি সৈন্যরা অভিযান চালায়। রাতের বেলা আজাদদের মগবাজারের বাড়িও ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি বাহিনী। কাজী কামাল পাকিস্তানি অফিসারের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গুলি করতে করতে পালিয়ে যান। কিন্তু ধরা পড়ে আজাদ, জুয়েল, বাশার। গুলিবিদ্ধ হয় আজাদের খালাতো ভাই জায়েদ আর টগর। গোলাগুলির একপর্যায়ে টমাস মানের ম্যাজিক মাউন্টেইন বইটাতেও গুলি লাগে।
আজাদকে রমনা থানায় রাখা হয়। আজাদের মা তার সঙ্গে দেখা করেন। বলেন, শক্ত হয়ে থেকো বাবা, কোনো কিছু স্বীকার করবে না।
ওই দিনই ধরা পড়ে রুমী, বদি-সমেত অনেক মুক্তিযোদ্ধা।
পরের দিন মা অনেক যত্নœকরে ভাত রেঁধে রমনা থানায় যান। গিয়ে দেখেন ছেলে নেই। এই ছেলে আর কোনো দিনও ফিরে আসেনি, আর এই মা ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন, এই ১৪ বছর তিনি আর কোনো দিনও ভাত খাননি।
আজাদ বলে, মা, কদিন ভাত খাই না। কাল যখন আসবে, আমার জন্য ভাত নিয়ে আসবে।
ওই দিন ধরা পড়া জুয়েল, বদি, রুমী, বাশার—এই রকম অনেক কিশোর তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আর কোনো দিনও ফিরে আসেনি।
জুরাইন কবরস্থানে এই মা মোসাম্মৎ সাফিয়া বেগমের কবরে লেখা আছে, শহীদ আজাদের মা।
তাঁদের কাহিনি আমার লেখা মা বইটি ছাড়াও জানা যাবে জাহানারা ইমামের লেখা একাত্তরের দিনগুলি, হাবিবুল আলমের লেখা ব্রেভ অব হার্ট প্রভৃতি বইয়ে।
মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদের মায়ের এই বীরত্বপূর্ণ কাহিনির সন্ধান আমাকে দিয়েছিলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। কিন্তু ব্যক্তি আজাদ ও তার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে তিনি খুব বেশি জানতেন না। আমি দৈনিক প্রথম আলোয় বিজ্ঞাপন দিই। আজাদের পরিবার সম্পর্কে কেউ কিছু জানেন কি না। আজাদের ছোট মা সাড়া দেন। এরপর আজাদের একজন আত্মীয় সন্ধান দেন ফেরদৌস আহমেদ জায়েদের। জায়েদ ছিলেন আজাদের চাচাতো ও খালাতো ভাই এবং আজাদের সার্বক্ষণিক সহচর। তাঁর মাধ্যমেই আজাদের চিঠিপত্র, ছবি, আজাদের নিজের হাতে লেখা জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ’ গানের কপি ইত্যাদি আমার হাতে আসে। সেসবের অনেকগুলোই জায়েদ ভাই আর আমি আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রদান করি।
গুলিবিদ্ধ বইটাও তারই অংশ। আজাদ, রুমী, বদিউল আলম বদি, জুয়েল—একাত্তরের আরবান গেরিলারা প্রায় সবাই খুব বই পড়তেন, আজাদের সংগ্রহে অনেক বই ছিল, তাদের বাড়িতে থাকা শহীদ আবুল বাশারও বই পড়তেন। এদের অনেকেই খুব ভালো ছাত্রও ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গুলিবিদ্ধ আজাদের বইটা যেন বহু কিছু বলছে। বলছে যে পাকিস্তানিরা শুধু বাঙালির শত্রু ছিল না, তারা ছিল মুক্তির শত্রু, জ্ঞানের শত্রু, বিদ্যার শত্রু, মুক্তচিন্তার শত্রু; আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল তাই মায়ের মুক্তির লড়াই, মাটির মুক্তির লড়াই, জ্ঞানের এবং চিন্তারও মুক্তির লড়াই।
আপনার মন্তব্য লিখুন