- শাহজাহান কিবরিয়া
আদালত প্রাঙ্গণ লোকে লোকারণ্য। আদালত দর্শক-শ্রোতায় পরিপূর্ণ। আজ এডিস মশার বিচার হবে। তার অপরাধ, সে দলবল নিয়ে ভয়াবহভাবে বাংলাদেশ আক্রমণ করেছে। এতে অসংখ্য লোক হতাহত হয়েছে। এডিস মশাদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বাংলাদেশ সরকার ব্যাপক অভিযান শুরু করেছে। মাত্র গতকাল একজন এডিস মশাকে আটক করা হয়েছে। আসামির কাঠগড়ায় এডিস। বাদী ঢাকা পশ্চিম সিটি কর্পোরেশনের মাননীয় মেয়র। মঞ্চে বিচারকের আসনে কালো গাউন পরা মহামান্য বিচারপতি। তার দুই পাশে চারজন জুরি বোর্ডের সদস্য উপবিষ্ট।
সরকার পক্ষের উকিল আসামি এডিসের বিরুদ্ধে অপরাধের বিস্তারিত বর্ণনা করে অগণিত মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের জন্য বিচারকের কাছে তার মৃত্যুদ- প্রার্থনা করলেন। মহামান্য বিচারপতি অভিযোগ শুনে এডিস মোশাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করে জবানবন্দী দিতে বললেন।
আসামি এডিস মশা বলল, মহামান্য আদালত, আমার অপরাধ স্বীকার করে আমি একবার পুলিশ রিমান্ডে জবানবন্দী দিয়েছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুলিশ আমার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়েছে। দ্বিতীয়বার ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আমার অপরাধ স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছি। প্রয়োজন হলে আমার অপরাধ স্বীকার করে আরও জবানবন্দী দেব। কিন্তু একটা কথা।
বিচারপতি বললেন, কি কথা? তোমাকে তোমার সব কথা বলার সুযোগ দেয়া হবে। তোমার প্রতি সুবিচার করা হবে।
বিচারকের আশ্বাস বাণীতে উৎসাহিত হয়ে মশা বলল, আমার বিচার করার আগে আদালতের সামনের ভাস্কর্যের চোখের বাঁধন খুলে দিতে হবে। বিচারক বললেন, ওটা খোলা যাবে না। ওটা নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার প্রতীক। এই প্রতীক পৃথিবীর সব দেশেই আছে।
এডিস বলল বিচারককে নিরপেক্ষ হতে হলে সব দিক ভাল করে দেখতে হয়। চোখ বন্ধ থাকলে কোন্টা সত্য আর কোন্টা মিথ্যা বুঝবেন কীভাবে? বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?’
বিচারক ভ্রুকুঞ্চিত করে বললেন, তোমার কবিতা বন্ধ কর। তোমার কোন বক্তব্য থাকলে বলো। তিনি সরাসরি রবীন্দ্রনাথের বিরেইধতা করলেন না। এককালে তিনিও এ কবিতা পাঠ করেছিলেন। এখন অবশ্য পাঠ্যপুস্তকে এ কবিতা নেই।
এডিস মশা বলল, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি মানুষকে শোষণ করি, মানুষের রক্ত পান করি। আমার প্রশ্ন মানুষের রক্ত শোষণ করে না কে? সবল সব সময় দুর্বলের রক্ত শোষণ করে। গরিব মানুষের রক্ত শোষণ করে ধনীরা দিন দিন আরও ধনী হচ্ছে, মোটা তাজা হচ্ছে, কোরবানির গরুর মতো। তাদের সম্পদের পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে হতভাগ্য দরিদ্র মানুষেরা অভুক্ত অবস্থায় মারা যাচ্ছে।
একটা মাছি অনেকক্ষণ ধরে এডিসের নাকে মুখে ভন ভন করে বিরক্ত করছিল। এডিস তাকে না মেরে পাখা দিয়ে তাড়িয়ে দিয়ে আবার বলতে শুরু করল, মানব সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে মানুষ সব সময় গর্ববোধ করে থাকে। আসলে মানব সভ্যতার ইতিহাস হচ্ছে, দুর্বলের ওপর সবলের আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস। মানুষের দ্বারা মানুষকে শোষণের ইতিহাস। এভাবে অত্যাচারী মানুষ সমাজে তার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখে আসছে। তাদের অত্যাচার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলে অনেক সময় দুর্বল মানুষেরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। অত্যাচার সহ্যসীমা অতিক্রম করলে তারা তাদের দলের কোন দরদী ব্যক্তির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তাঁকে আক্রমণ করে। যেমন, বাঙালীরা করেছিল ১৯৭১ সালে। তারা তাদের নেতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শক্তিশালী পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে যুদ্ধে পরাস্ত করে তাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। আমরা কখনও পরের অধিকারের হস্তক্ষেপ করি না। নিজেদের খাদ্য অন্বেষণ নিয়ে সদা ব্যস্ত থাকি।
মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু মানুষ। এডিস মশারা নয়। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, পরের ধনের প্রতি লোভ এবং ধর্ম রক্ষার অজুহাতে মানুষ একে অপরকে হত্যা করে। আপনাদের ইতিহাস দেখুন; কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, কারবালার যুদ্ধের কথা স্মরণ করুন। চেঙ্গিস খান, হালাকু খান কত অসংখ্য মানুষ হত্যা করে, মানুষের খুলি দিয়ে স্তম্ভ তৈরি করেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী রাজাকার-আলবদরের সদস্যরা মানুষের চোখ উপড়ে ফেলে তা দিয়ে বস্তা ভর্তি করেছিল। আমেরিকা ও স্পেনের গৃহযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধে অসংখ্য মানুষের মৃতদেহ দেখে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছিলেন। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোটি কোটি মানব সন্তানের মৃত্যু হয়েছিল। আমেরিকা জাপানের নাগাসাকি ও হিরোশিমার ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলে শহর দুটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। আব্রাহাম লিংকনের দেশ আমেরিকা ভিয়েতনামের স্বাধীনতাকামী অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছিল। হিটলার ৬০ লাখ ইহুদী নর-নারী ও শিশুকে হত্যা করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যরা ৩০ লাখ লোককে হত্যা করে। উগান্ডা, রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়া, বসনিয়া, মিয়ানমারসহ অনেক দেশে ব্যাপক গণহত্যা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালত অনেক দেশের গণহত্যার বিচার করলেও বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের গণহত্যার বিচার করেনি। বিভিন্ন দেশে এখনও গণহত্যা চলছে। যুদ্ধ চলছে। অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশগুলো তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ, গণহত্যা অব্যাহত রেখেছে। দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনীদের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। অহিংস ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের অনুসারীদের দেশ মিয়ানমার লাখ লাখ মুসলিম রোহিঙ্গাদের নির্যাতিত করে, হত্যা করে, নিজ মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সেখানে শরণার্থীরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ্ববাসী ‘মানবতার মাতা’ আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে তারা কোন বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে না। এখন শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারত অসম থেকে কয়েক লাখ লোককে মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ করার উদ্যোগ নিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে অকারণ যুদ্ধে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মরছে, একটুখানি আশ্রয়ের আশায় সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা যাচ্ছে মানুষ। শান্তির অগ্রদূত পবিত্র ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহম্মদ (স)-এর কিছু পথভ্রষ্ট ধর্মান্ধ মুসলমান নামের কলঙ্ক ব্যক্তি ধর্মীয় পবিত্রতা রক্ষার অজুহাতে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ অসংখ্য উপাসনালয় বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। প্রার্থনারত বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে হত্যা করছে। পাল্টাপাল্টি হত্যাকা- ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। এমন কি বিয়ে বাড়ির উৎসবেও মানুষ মারা হচ্ছে। অহিংস বাণীর ধারক ও বাহক মহাত্মা গান্ধীর ধর্মনিরপেক্ষ ভারত নিরীহ কাশ্মীরী জনগণের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।
একটু থেমে এডিস আবার বলতে শুরু করে, ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরে অবস্থিত জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জনতার ওপর গুলি করে ইংরেজ সৈন্যরা অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। এর প্রতিবাদে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি বর্জন করেন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ঢাকায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। আওয়ামী লীগে সভাপতি ও বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সন্ত্রাস বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ওপর ক্ষমতাসীন দল বন্দুক ও গ্রেনেড দিয়ে হামলা চালায়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও আইভি রহমানসহ অসংখ্য লোক হতাহত হয়। বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করাই ছিল এ হামলার মুখ্য উদ্দেশ্য। একই ঘটনা ইতোপূর্বে ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৭৫ সালের ৩ নবেম্বর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা : সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানকে বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয়। পরবর্তীকালে তথাকথিত সভ্য মানুষের দাবিদার ক্ষমতাসীনরা হত্যাকারীদের বিচার না করার জন্য সংসদে দায়মুক্তি বা ‘ইনডেমনিটি’ আইন পাস করে। বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে সেনানিবাসে বিচারের নামে প্রহসন করে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দেয়া হয়। আইনে মৃত্যুদ-ের বিধান না থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসি দেয়া হয়। জানা যায়, এই মৃত্যুদ- কার্যকর করার এক সপ্তাহ পর বিধানে মৃত্যুদ- শব্দটি সংযোজন করা হয়।
অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল ও পরধন লোভে মত্ত ক্ষমতাধর মানুষ সাধারণত এসব পাপ কর্মে লিপ্ত থাকে। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন, ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভূরি ভূরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি।’
মহামান্য আদালত, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি রক্ত শোষণ করেছি। ছারপোকা আর এডিস মশাদের একমাত্র খাদ্য মানুষের রক্ত। এ জন্য মানুষই কেবল কালাজ্বর ও ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়। আমাদের খাদ্যের বিকল্প ব্যবস্থা থাকলে আমরা কখনও মানুষের রক্ত শোষণ করতাম না।
সব প্রাণীরই বাঁচার অধিকার আছে। মানুষের বাঁচার জন্য অসংখ্য বিকল্প খাদ্য ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও মানুষ অহরহ অন্য মানুষকে শোষণ করছে, হত্যা করছে, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে, খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে অসংখ্য মানুষের জীবন বিনাশ করছে। এরা নিজ সন্তানকে হত্যা করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। হত্যা, ধর্ষণ, ক্রসফায়ার, সড়ক দুর্ঘটনা, ডাকাতিসহ অসংখ্য সন্ত্রাসী কর্মকা-ে মানুষ নিহত হচ্ছে। সেই তুলনায় ডেঙ্গু রোগে বা কালাজ্বরে আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা খুবই নগণ্য।
বিপথগামী মানুষকে সৎপথে আনার জন্য কত ধর্ম, কত মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে। তবু প্রকৃতির আইন মানুষই ভঙ্গ করছে। এডিস মশাদের আইন আদালত নেই। মামলা মোকদ্দমা নেই। আমরা পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত এবং অনুগত। আমরা একতাবদ্ধ হয়ে বাস করি। জীবন ধারণের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য মানুষের রক্ত পান হালাল করে দিয়েছেন। তিনি সকলের অন্নদাতা। তাঁর নির্দেশ আমরা কখনও অমান্য করি না। কিন্তু বলদর্পী মানুষ আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে আমাদের বাসস্থান ধ্বংস করছে, আগুন জ্বালিয়ে, ওষুধ ছিটিয়ে আমাদের নির্বংশ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। দেশব্যাপী লঙ্কাকা- করে বেড়াচ্ছে। আপনারা আমার বিচার করছেন। অথচ আপনারাই উপদেশ দেন, আপনি আচরি ধর্ম পরকে শিখাও।’
মহামান্য আদালত, কিছু মনে করবেন না। কুকুরের সঙ্গে মানুষের চরিত্রের কিছু মিল রয়েছে। কুকুরের মতো মানুষ পদলেহী হতে দ্বিধা করে না। কুকুরের মতোই তারা পরস্পরকে হিংসা করে, হানাহানি করে এবং একে অপরের ভাল সহ্য করতে পারে না। প্রভুকে দেখলে প্রভুর মন পাবার জন্য খুশিতে লেজ নাড়াতে শুরু করে। ঠিক তেমনি কুকুর স্বভাবের চাটুকারদের যদি লেজ থাকত তারাও তাদের লেজ নাড়াত। এদেরই বঙ্গবন্ধু চাটার দল বলতেন। এরা সবকিছু খায়।
কুকুরের স্বভাবের সঙ্গে মানুষের কিছু কিছু মিল থাকলেও কিছু অমিলও আছে। কুকুর প্রভুভক্ত এবং বিশ্বস্ত হয়। কিন্তু মানুষ প্রভু ভক্ত ও বিশ্বস্ত নয়। মানুষ কুকুরকে পাহারায় রেখে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে। কুকুর নিজের জীবন বিপন্ন করে প্রভুর প্রাণ রক্ষা করে। কিন্তু মানুষ ঘুমন্ত প্রভুকে হত্যা করে।
মানুষ দু’মুখো প্রাণী। কথা ও কাজে তাদের মিল থাকে না। মুখে যা বলে কাজ করে তার বিপরীত। মানব চরিত্রে শঠতা, প্রতারণা, তঞ্চকতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা বিদ্যমান। যাকে যদি কোন মানুষ বিশ্বাস করে এবং ভালবাসে সেই আবার তাকে ঠকায়, তার সঙ্গে প্রতারণা করে, বিশ্বাসঘাতকতা করে। উপকারির অপকার করে থাকে। এদের বলা হয় মোনাফেক। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবনের শেষ পরিণতির কথা স্মরণ করুন। নবাবকে শত্রুর নিকট ধরিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর অতি বিশ্বস্ত একান্ত অনুগত আত্মীয় মন্ত্রী মীর জাফর আলী খান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে ছিলেন তাঁরই এককালের বিশ্বস্ত ও একান্ত অনুগত মন্ত্রী লেবাসধারী খোন্দকার মোশতাক আহমদ। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসিবে বঙ্গবন্ধুর খুনীরা বিশ্বাস অর্জনের জন্য পূর্ব থেকেই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সস্ত্রীক আসা-যাওয়া করত, খাওয়া-দাওয়া এবং গল্প-গুজব করে বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে ভাব জমাত। এদের ওপর গভীর আস্থা রেখেই বঙ্গবন্ধু একজন সাধারণ নাগরিকের মতো জীবনযাপন করতেন। জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে সাধারণ একটি বাড়িতে সপরিবারে বাস করতেন, নিশ্চিন্তে ঘুমাতেন। মানুষের প্রতি তাঁর গভীর আস্থা ও ভালবাসার সুযোগে রাতের অন্ধকারে ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ভবিষ্যতে হত্যাকারীদের মধ্যে একদা বিশ্বস্তদের অতি পরিচিত মুখ দেখতে পেয়ে সেই মুহূর্তে হয়ত বঙ্গবন্ধুর মনে পড়েছিল স¤্রাট জুলিয়াস সিজারের জীবনের শেষ উক্তি, ‘ইউ টু ব্রুটাস’ (ব্রুটাস তুমিও)। জুলিয়াস সিজারকে হত্যা করেছিল তাঁর একান্ত বিশ্বস্ত অনুচর ব্রুটাস।
এডিস মশার গলার স্বর কমে আসছিল। ফ্যাসফেসে গলায় সে বলতে শুরু করল, মহামান্য আদালত আমরা অভিজাত শ্রেণীর প্রাণী। পবিত্র ও স্বচ্ছ পানিতে আমাদের জন্ম এবং বাস। এ জন্য আমাদের স্বভাব চরিত্র উন্নত। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ। আমাদের চরিত্রে কোন দ্বিচারিতা নেই। আমরা স্বচ্ছতার সঙ্গে সব কাজ করি। আমরা অন্ধকার রাতে ঘুমন্ত মানুষের রক্ত শোষণ করি না কেননা তাতে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। আমরা দিনের আলোতে মানুষের রক্ত পান করি। আমাদের মধ্যে মানুষকে সজাগ এবং সতর্ক থাকার সুযোগ করে দিই। আমাদের চরিত্রে কোন লুকোচুরি নেই। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ মানুষের রক্ত হালাল করে দিয়েছেন। আল্লাহর রহস্য বোঝা দায়।
মানুষ আর কুকুরের স্বভাবের সঙ্গে আমাদের কোন মিল নেই। আমরা কারও পদলেহন করি না। নিজের মধ্যে বিবাদ করি না। দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করি। কারও বিশ্বাস ভঙ্গ করি না।
মহামান্য আদালত, আপনারা বলেন, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আমরাও তা স্বীকার করি। কিন্তু গরু শ্রেষ্ঠত্বের আসন দখল করে আজ ধর্মান্ধ মানুষের দ্বারা পূজিত হচ্ছে। শ্রেষ্ঠ প্রাণীর দাবিদার মানুষের কী করুণ পরিণতি! ভাল-মন্দ বিচার করার জন্য আল্লাহ মানুষকে বিবেক দান করেছেন। অন্য কোন প্রাণীকে এ মূল্যবান সম্পদ দেননি। কিন্তু ক্ষমতার গর্বে বলীয়ান আত্মম্ভরী মানুষ বিবেকের ধার ধারে না। তারা বিবেকের তোয়াক্কা করে না। বিবেক বিবর্জিত মানুষকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। যে মানুষ বিবেকের নির্দেশ মেনে চলে না, বিবেক তাকে ছেড়ে চলে যায়।
মহামান্য আদালত, আপনি বিচারকের আসনে বসেছেন। বিচারক আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহর শ্রেষ্ঠ উপহার বিবেকের অধিকারী আপনি। আপনার বিচারের প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। আমার আচরণের জন্য আমি মোটেই দুঃখিত, লজ্জিত বা অনুতপ্ত নই। আমার মধ্যে কোন অপরাধবোধ নেই। আমি যা করেছি আল্লাহর নির্দেশ মেনেই করেছি। আল্লাহর নির্দেশের অন্যথা করিনি। আপনার বিচার আমি মাথা পেতে নেব। মহান আল্লাহ আপনার সহায় হোন।
এডিস মশা তার জবানবন্দী শেষ করে নিজ আসনে বসে পড়ল।
মহামান্য বিচারক জুরিদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলাপ আলোচনা করলেন। নিজের মাথা চুলকালেন। জুরিগণও তাঁকে অনসুরণ করে নিজ নিজ মাথা চুলকালেন। কেউই নিজেদের মধ্যে বিবেকের অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন না। অবশেষে সর্বসম্মতিক্রমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেল। মহামান্য বিচারপতি মানুষ হত্যার দায়ে আসামি এডিস মশাকে দোষী সাব্যস্ত করে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, সকল দিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা ও বিবেচনা করে আসামির সকল অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে মৃত্যুদ- দেয়া হলো। অবিলম্বে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অপরাধীর মৃত্যুদ- কার্যকর করার নির্দেশ দেয়া হলো।
আপনার মন্তব্য লিখুন