রঙের জীবন

ক্রাইম থ্রিলার নাকি সোশ্যাল রেভেঞ্জ?

 সবুজ খন্দকার।

 

চলচ্চিত্র: ভিঞ্চি দা

পরিচালক: সৃজিত মুখার্জি

কলাকুশলী: রুদ্রনীল ঘোষ, হৃত্বিক চক্রবর্তী, সোহিনী, অনির্বাণ ভট্টাচার্য

দেশ: ভারত

সাল: ২০১৯

রেটিং: ৩.৫/৫

 

প্রাককথা
সৃজিত মুখার্জী আর থ্রিলার জনরার যেন এক গভীর মেলবন্ধন আছে। কলকাতার সিনেমা যখন দক্ষিণী ছবির নকল আর ফর্মূলা ছবির সাজানো মোড়কে একঘেয়েমি আর ব্যবসায়িকভাবে মন্দায় যাচ্ছিল, সৃজিত তখনই নির্মাণ করেছিলেন ‘বাইশে শ্রাবণ‘। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন বলে যারা সাহিত্যের সাথে যোগসূত্র খুঁজতে হলে গিয়েছিলেন , তারা মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখে ফিরেছিলেন আগাগোড়া ক্রাইম থিলার এক ছবি, যার কেন্দ্রবিন্দুতে আবার বুম্বাদা (প্রসেনজিৎ)। ‘অটোগ্রাফ‘ ছবি দিয়ে যাদের পরিচয় সৃজিতের সাথে তারা বলছিলেন, আসলে থ্রিলার জনরাই বোধহয় সৃজিতের ‘হোমগ্রাউন্ড‘। ‘চতুষ্কোণ‘ করে তাদের সেকথার মিল রাখছিলেন বেশ। কিন্তু এরপর কেটে গেছে পাঁচ বছর। সৃজিত নিজেকে ভেঙ্গেচুড়ে করেছেন অনেক ছবি, কিন্তু দর্শকমনে ছিল সেই থ্রিলারের ক্ষুধাই। ফ্লপ যাওয়া ছবি ‘শাহজাহান রিজেন্সি” থেকে সৃজিত এই বছরে তার দ্বিতীয় ছবি ‘ভিঞ্চি দা‘ নিয়ে ফিরে এলেন সেই থ্রিলারের স্বরূপে। আর এই গরমে দর্শক মজে গেল ক্রাইম, সাইকো আর সাসপেন্সের এক মোহনায়।

গল্প
ছবির মূলভাবনা আসলে অভিনেতা রুদ্রনীলেরই। ‘এক যে ছিল রাজা‘ করার সময়ই এই গল্পটি তিনি শোনান সৃজিতকে। ভাল লেগে গেলে সৃজিত গল্পটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ থ্রিলারের রূপ দেন। মেকাপ আর্টিস্ট সোমনাথ সেনের জীবনের এক কষ্টকর ঘটনা ব্যথিত করে রুদ্রকে। সেই ঘটনা তিনি নিজে চরিত্রে রূপদান করে পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছেন। থ্রিলার ছবির গল্পের বুনন আর ক্লাইম্যাক্সটা বলে দিলে সেটা অন্তঃসারশূণ্য কঙ্কালের মত লাগে। তাই যদি সংক্ষেপে বলি, ছবির গল্প শুরু হয় একজন মেকাপ আর্টিস্টের নিজের বয়ানে। পুরো ছবিটা সেই বয়ানেই শেষ হয়। সে চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ভক্ত হিসেবে টালিগঞ্জে পরিচিত হয় ‘ভিঞ্চি দা‘ নামে। তার বাবার হাত ধরে মেকাপে আসলেও এটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিতে তাকে অনেক পড়তে ও প্রয়োগ করতে হয়। ধীরে ধীরে একজন মেকাপ আর্টিস্ট হিসেবে তার মনে প্রবল আত্নসম্মানবোধ আর রুচিবোধের জন্ম নেয়, হয়ে উঠে পুরদস্তুর পেশাদারি। কিন্তু টালিগঞ্জে সে এর কদর তো পায়ই না বরং চরম ঘৃণা নিয়ে সে নিজের এলাকার যাত্রা আর প্রসথেটিক মেকাপ যা কিনা চেহারাকে অবিকল অন্যের চেহারায় রূপ দিতে পারে, সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এলাকায় তার সখ্যতা হয় জয়ার সাথে, যার আবার কথা বলায় সমস্যা (খাটি বাংলায় তোতলা)। জয়াকে নিজের অনুপ্রেরণা মনে করে সংসার পাততে চায় সে।

জয়া আর ভিঞ্চি দা চলমান জীবন সংগ্রামে নিজেদের নিয়ে যখন স্বপ্ন দেখছে, তখন ভিঞ্চির কাছে আগমন ঘটে আদি বোসের। আদি বোস নিজেকে একজন আইনজীবি ভাবতে পছন্দ করে, যদিও তার শিক্ষাগত যোগ্যতায় সে আইনজীবি নয়। কিন্তু ছোটবেলা থেকে আইন সংক্রান্ত বিষয়ে প্রবল আগ্রহ ও পড়াশুনা, কেস স্টাডি, আদালত পাড়ায় আসা যাওয়া আর বিভিন্ন মামলার জেরা শুনানির অভিজ্ঞতা তাকে এমন অবস্থায় নিয়ে আসে যার কাছে পেশাদারি উকিলরাও এসে বসে থাকে বিভিন্ন পরামর্শ নিতে। রায়ের ধারার মত আদি বোসের নীতিতে মুখস্থ থাকে সততা ও ন্যায়ের জয়। কিন্তু পারিপার্শিক বিভিন্ন অসংগতি আর টাকার কাছে ন্যায়বিচারের হেরে যাওয়া তাকে বাধ্য করে অন্য রাস্তা বেছে নিতে।

ভিঞ্চির কাছে আদিবোসের আসার কারন ছিল, প্রসথেটিক মেকাপ নিয়ে সে একজন ক্রিমিনালের চেহারায় ঘটিয়ে বসবে অপরাধ। আর সেটাকে সূত্রধরে পুলিশ সেই ক্রিমিনালকে গ্রেফতার করবে আর ভিঞ্চিকেও জিম্মি করে ব্যবহার করবে। এটা হলে, ধর্ষণ ব্যাংকলুট আর কুকর্ম করে টাকার জোরে বেঁচে যাওয়া ক্রিমিনালের সাজাও হয় আবার সেটায় আইনের বৈধতাও থাকে। কিন্তু সেই চেহারায় আদিবোস যেসব কান্ড ঘটায় তাতে মারা পরে নিরীহ কিছু মানুষও। ভিঞ্চি সেগুলো জানতে পেরে নিজেকেও ভাবতে থাকে আদিবোসের মতই খুনী আর মৃতদের আত্না তাকে প্রতিদিন বিবেকের কাছে দংশন করতে থাকে। একদিকে তাই সে মুক্তি চায় আদিবোসের কাছ থেকে, অন্যদিকে আদিবোসের যুক্তি ন্যায়ের লড়াইয়ে কিছু লোক মারা পড়তেই পারে – তাতে অন্যায় নেই। একসময় ভিঞ্চি দা তার শেষ মেকাপটি আদিবোসকে করে দিলে তার নিজের জীবনেই ঘটে যায় অভাবিত সেই সংকট। এক সাইকো কে থামাতে ভিঞ্চি এরপর কী করলেন, থামাতে পারলেন কিনা , পারলেও তিনি নিজে কীভাবে চৌকশ ডিসিডিডি পুলিশ বিজয় পোদ্দারের হাত থেকে বাঁচলেন বা জেলে গেলেন, জয়ার শেষ পরিণতি বা কী – সেটিই ছবির ক্লাইম্যাক্স। ছবিতে একটি বিশেষ কারনে আদিবোসের ছেলেবেলার একটু ব্যাকড্রপ দেখানো হয়েছে ভয়ংকরভাবে, সেটিও বলা যাবে না।

অভিনয়
প্রথমত ভিঞ্চি দার চরিত্রে রুদ্রনীল ছিলেন অনবদ্য, একবারও মনে হয় নি এই চরিত্রে সে বেমানান। গল্পটি নিজের বলেই কিনা অনেক বেশি চরিত্রে ঢুকে পড়ার ছাপ পাওয়া গেছে তার বাচনভঙ্গি, গেটাপ, কান্না আর চরিত্রের বিভিন্নতায়। বিশেষ করে ক্লাইম্যাক্সে আদিবোসের চরিত্রে ঋত্বিকের সাথে তার শেষ বোঝাপড়া আর সমাপ্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয় ‘বাইশে শ্রাবণ‘র সেই পরমব্রত আর বুম্বাদার সংলাপ আর আবহকে। রাগ, অসহায়ত্ব আর প্রেমে সোহিনীর সাথেও তার সহজ সাবলীল অভিনয় ভাল লেগেছে।

সাইকো এবং ক্রিমিনাল লইয়ার দুটোকে একসঙ্গে বন্দি করে সেটা মৌখিক আর নিরবতায় পর্দায় উত্তেজনা সৃষ্টি করতে ঋত্বিক দারুন অভিনয় করেছেন। এক কথায় তার চরিত্রে মানিয়ে যাওয়া থেকেও উপভোগ্য ছিল ভয়ংকর ভাবে নিজেকে উপস্থাপন। সেটিতে তিনি দশে দশ পাবেন। যদি আরেকটু স্পষ্ট করে বলি, সাইকো চরিত্রের হেসেখেলে খুন ও তার আবার যুক্তি দেখানো সংলাপ ঋত্বিকের মুখে অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে। আদিবোস অনেকদিন মনে রাখার মতই চরিত্র।

ছবির বাদবাকি চরিত্র আসলে পার্শ্ব ভূমিকা রেখেছে। জাদরেল পুলিশ বিজয় পোদ্দারের ভূমিকায় অনির্বাণ তার অন্যান্য কাজের মতই খুব সহজাত ও কড়া ভূমিকা রেখেছেন। অভিনয়ের জায়গা কম থাকলেও অনির্বাণ যতক্ষন পর্দায় ছিলেন, দর্শক পর্দার ক্রিমিনালের মতই তাকে ভয় পেয়েছে আইনের প্রতি তার নিবেদন ও সততা দেখে।

জয়াও একটি অপ্রধান চরিত্র, তবে তোতলামি করতে ভালই হোমওয়ার্ক করতে হয়েছে সোহিনীকে তা বোঝাই যায়। অভিনয়ে তিনি আগেই নিজেকে প্রমাণ করেছেন বারবার, এখানেও দারুণ।

এছাড়া খুব অল্প সময়ের জন্যে এসেও যে পুরো ছবিতে প্রভাব রেখে গেছে সে আদিবোসের ১৭ বছর বয়সের চরিত্র, ঋদ্ধি সেন। ছবির প্রথমেই এমন এক ভয় পাইয়ে দেয়া, সাইকো দৃশ্যের অবতারনা সফলভাবে করা ওর পক্ষেই বোধহয় সম্ভব। এই বয়সেই সে নিজেকে প্রমাণ করেছে, সে ‘লম্বা রেসের ঘোড়া‘।

পরিচালনা
সৃজিতের পরিচালনা নিয়ে বলার কিছু নেই, তবে শেষ কয়েকটা ছবিতে কেন যেন সেই শুরুর দিকের সৃজিতকে পাওয়া যাচ্ছিল না। বিশেষ করে, শাহজাহান রিজেন্সি‘ র গল্প বা ‘এক যে ছিল রাজা‘ র পটভূমি একটা বড় অংশের দর্শককে ঘুরেফিরে মনে করিয়ে দিচ্ছিল সেই উত্তম কুমারের ‘চৌরঙ্গী‘ আর ‘সন্ন্যাসী রাজা‘ র কথা। তবে কাহিনী আর থ্রিলার পরিচালনায় সৃজিত আবার নিজেকে আগের অবস্থানে নিয়ে এসেছেন এই ছবি দিয়ে। এটিতে তার সিগনেচার ডিরেকশন স্পষ্ট। তাছাড়া, দর্শকও এভাবে তাকে হল থেকে বাড়ি বয়ে নিতে অভ্যস্ত আবার হলে আনতে।

তবে হয়তো শেষদিকে একটু বেশি অনুমিত ছিল। দর্শক আঁচ করতে পারছে কি হবে, কিন্তু কিভাবে হবে তা জানেনা। এইদিক থেকে এটা দূর্বলতা বা নতুন মোড়ে বাঁক নেয়া দুটোই হতে পারে।

চিত্রগ্রহণ
ছবির সিনেমাটোগ্রাফির সবচেয়ে বড় দিক এর সাসপেন্স জমানো। কাহিনী এগুতে থাকলে এর দৃশ্যায়ন আরো কঠিন হতে থাকে, কারন দর্শক তখন অনেক কিছু জানে আবার তার কাছ থেকে অনেক কিছু লুকিয়েও রাখতে হবে। সেটি সুদীপ্ত মজুমদার ভালভাবেই করেছেন। বেশিরভাগ দৃশ্যায়ন ইনডোরে হওয়ায় এটাও একটা চ্যালেঞ্জ, প্রসথেটিক মেকাপে অবয়ব দানের দৃশ্য আর গানের দৃশ্যগুলো ক্যামেরায় ভালো লেগেছে।

সম্পাদনা
থ্রিলারের সম্পাদনায় সবচেয়ে বড় ব্যাপার টানটান ব্যাপারটা ধরে রাখা। আর এডিটিং টেবিলে তাই ঘটনার প্রেক্ষাপট কে দ্রুততার সাথে বুঝিয়ে দিতে হয়, সেটি বেশ ভালভাবেই পার করেছে। আর আহামরি কোন ভিজুয়াল না থাকায় সম্পাদনায় তেমন খুত থাকলেও খোলা চোখে পড়েনি ।

সঙ্গীত
গানের আয়োজনে অনুপম হলেন সৃজিতের পুরনো কমরেড। সঙ্গে রয়েছে ইন্দ্রদ্বীপ দাসগুপ্তের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। দুইয়ে মিলে খাবারে স্বাদ ছিল মুখে লেগে থাকার মতই। তবে এই ছবিতে গানের ব্যবহার খুব আবশ্যক কিছু না। সদ্য জনপ্রিয়তা পাওয়া নোবেলের গানটি ভালই সাড়া ফেলেছে। বাকিগুলো চলে।

লোকেশন
কলকাতার অলিগলি কে বাইশে শ্রাবণে যেভাবে দেখানো হয়েছে অনেকটা তেমনই। তবে সেটা ডিজাইন দারুন ছিল, বিশেষ করে ভিঞ্চি দার ঘরের।

দুর্বলতা
থ্রিলার তখনই দূর্বল যখন দর্শক কাহিনী বুঝে ফেলে বা অনুমান মিলে যায়। শেষের অংশটুকু অনেকেরই মনে ছিল যে এমনকিছু হবে। হয়েছেও তাই, তবে ভিঞ্চি আর জয়ার শেষ পরিণতিটা ভালই মজা দিয়েছে দর্শককে। তাদের প্রসথেটিক মেকাপ বোঝা যাচ্ছিল। এছাড়া, কিছু অংশে ভিঞ্চি আর আদিবোসের সংলাপ অনেক দীর্ঘ থাকায় বোরিং লেগেছে।

শেষকথা
বিভিন্ন জনরা এক্সপেরিমেন্ট করতে করতে আবার সৃজিত তার আতুঁরঘরে এসে ফাটিয়ে দিয়েছেন এটা বলাই যায়। থ্রিলারপ্রমী মানুষ ছবিটি দেখে উপভোগ করবেন নিঃসন্দেহে।