সোহাইল রহমান :
লাইফে প্রথমবারের মতো ‘ইন আ রিলেশনশিপ’ স্ট্যাটাস দিয়ে ছেলেটা খুশিতে দুই রাকআত শুকরিয়া নামাজ পড়ে ফেললো। যাক, শেষপর্যন্ত ভাগ্যের শিকে ছিড়েছে। এখন আর সবার মতই ওরও একটা সুইট, কিউট, স্মার্ট আর সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড আছে। যাকে মনের সব আবেগ নিয়ে বলা যায় ভালোবাসার সমস্ত কথা। সে মেয়েটাকে ফোন দিলো, ‘হ্যালো বাবু কি করো?’
‘এইতো জান শুয়ে আছি, তুমি?’
‘আমিও। একটা কাজ করতে পারবা?’
‘কি কাজ বলো।’
‘কাল ভোর সাতটায় আমার খুব ইম্পর্টেন্ট একটা ক্লাস আছে, তুমি ফোন দিয়ে ঘুম থেকে তুলে দিতে পারবা?’
‘অবশ্যই পারবো। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও।’
‘ওকে বাবু, লাভ ইউ। উমমমাহ।’
‘লাভ ইউ টু। উমমমাহ।’
আহা! জীবনটা এতো সুখের কেন! ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলো ছেলেটা। চোখে খুব সুন্দর একটা ভবিষ্যতের স্বপ্ন। যে ভবিষ্যৎ ভালোবাসা আর আনন্দে পরিপূর্ণ।
পরদিন সকাল এগারোটায় ঘুম ভাঙলো ছেলেটার। ফোনটা হাতে নিয়ে চেক করলো। নাহ কোনো মিসকল উঠে নেই। মেজাজ খারাপ হলো খুব। ফেবুতে লগইন করে একটা মেসেজ পেলো। মেয়েটা লিখেছে, ‘স্যরি বাবু আমি বলতে ভুলে গেছিলাম আমার ফোনে ব্যালেন্স নাই। এজন্য কল দিতে পারিনি। তুমি প্লিজ কিছু মনে কইরো না, আর ঘুম থেকে উঠেই আমার ফোনে কিছু টাকা রিচার্জ করে দিও। আই লাভ ইউ।’
কি আর করা! মেয়েটারও আসলে দোষ ছিলো না। ছেলেটা ফ্রেশ হয়ে মোড়ের দোকানে গিয়ে মেয়েটার নাম্বারে একশো টাকা রিচার্জ করে দিলো। দোকান থেকে বের হতে না হতেই কল চলে আসলো,
‘হাই, গুড মর্নিং।’
‘হুহ, আমার মর্নিং এতো গুড নাই।’
‘আহারে ক্লাস মিস হইছে বাবুটার। আমি এত্তোগুলা স্যরি।’
‘হুম ইটস ওকে। এতো স্যরি বলা লাগবে না।’
‘এইতো আমার কিউট বাবুতাহ। আজকের দিনের কথা মনে আছে তো?’
‘আজকের দিনে কি?’ ছেলেটা অবাক হলো। স্পেশাল কিছু নাকি!
‘ইস! তুমি ভুলে গেলে কিন্তু আমি খুব মন খারাপ করবো। কান্নাও করে দিতে পারি। আমি কতো আশা করে ছিলাম আমার বলে দেয়াই লাগবে না। তুমি নিজে থেকেই গিফট নিয়ে আসবা।’
‘গিফট! কেন? আজ তোমার বার্থডে নাকি?’
‘উহু তা কেন হবে। বুদ্ধুরাম! আজ যে আমাদের রিলেশনের পুরো একদিন পূর্ণ হইছে আর তুমি এটা ভুলে গেলে? নাকি গিফট দেয়ার ভয়ে, হুম?’
‘ওএমজি! কি বলো! একদিন পূর্ণ হইছে উপলক্ষেও গিফট দিতে হবে নাকি? কি আশ্চর্য!’
‘অবশ্যই দিতে হবে। একদিন উপলক্ষে দিতে হবে, এক সপ্তাহ উপলক্ষে দিতে হবে, একমাস আর একবছর উপলক্ষে তো অবশ্যই দিতে হবে। একদম কিপ্টেমি করবা না। জানো, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আছে না সোমা; ওর বিএফ ওকে রিলেশনের একঘণ্টা পূর্তি উপলক্ষে কি সুন্দর একটা নেকলেস যে দিয়েছিলো! আমার বিএফ এর একটা মান সম্মান আছে না।’
কি আর করা! গিফট দিতে হলো। মাসে শুরুতেই মানিব্যাগ হালকা হয়ে যাওয়ার দুঃখের চাইতে টেনশান বেশি হলো ছেলেটার। একসপ্তাহ পূর্তি উপলক্ষে তো আবার গিফট দিতে হবে! প্রথম মাসটায় মনে হয় একটু কষ্ট হবে। টেনশনে রাতে ঘুমই হলো না ঠিকমতো। জেগেই ছিলো ও তারপরও ঠিক ভোর সাতটায় কল আসলো ফোনে। যাক মেয়েটা না বলতেও মনে রেখেছে। এই না হলে গার্লফ্রেন্ড!
‘হ্যালো জান গুড মর্নিং। আজকে ক্লাস নেই?’
‘হুম আছে তো। সাড়ে নয়টায়।’
‘ওহ, আমি কি ঘুমের ডিস্টার্ব করলাম?’
‘আরে নাহ! আমি জেগেই ছিলাম।’
‘দ্যাটস গুড! সকালে ঘুম থেকে ওঠা খুব স্বাস্থ্যকর। আচ্ছা বাবু বলো তো আজ বিশেষ কি দিন?’
ছেলেটা অনেক চিন্তাভাবনা করেও আজকের দিনের কোনো বিশেষত্ব খুজে পেলো না।
‘কি হলো, চুপ করে আছো কেন? কোন দুনিয়ায় থাকো তুমি? আজ যে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস সেটা ভুলে বসে থাকলে? আমার গিফট কই?’
‘গি-গিফট মানে? কিসের গিফট?’
‘উফফ আজকে এত্তো স্পেশাল একটা দিবস আর তুমি আমাকে গিফট দিবা না? মেয়েটা কাদো কাদো গলায় বললো, ‘ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে এতোটুকু আশা কি করতে পারে না একটা মেয়ে! তুমি জানো আমার ফ্রেন্ড সোমার বিএফ ওকে বিশ্ব ডায়রিয়া দিবস উপলক্ষে গতবার একটা হীরের দুল গিফট করেছে। আর তুমি? বুঝেছি আমাকে একদম ভালোবাসো না।’
কি আর করা! ভালোবাসার মান রক্ষা করতে ফ্রেন্ডের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে দিতে হলো গিফট। গিফট নিয়ে, রেস্টুরেন্টে খেয়ে যথাযথ উৎসাহ আর উদ্দিপনার মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালন করে বাসায় ফিরলো মেয়েটা। যাওয়ার আগে ছেলেটার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলো, ‘দেখ ডেইলি ডেইলি তুমি ভুলে যাবা আর আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিতে পারবো না। এই লিস্টটা আমার বান্ধবী সোমার থেকে এনে তোমার জন্য ফটোকপি করে দিলাম এক কপি। কাল থেকে আর যেন বলে দেয়া না লাগে। আর হ্যা ফটোকপি করতে দুই টাকা লেগেছে সেটা কে দেবে, হুম? দুই টাকা ভাংতি নাই? ওকে পঞ্চাশ টাকার নোটটাই দাও। আর হ্যা কালকেরটা মনে করায়ে দিচ্ছি। কাল কিন্তু জাতীয় কর দিবস। সুন্দর একটা গিফট চাই।’
‘ইয়ে বাবু… ছেলেটা আমতা আমতা করে বুঝানোর চেষ্টা করলো, দেখ এগুলা তো সবার জন্য। এসব দিবসে গিফট দেয়ার নিয়ম নাই। যেসব দিন শুধুমাত্র তোমার আর আমার জন্য সেসব দিনে অবশ্যই গিফট দেব। যেমন, তোমার বার্থডে, এনিভার্সারি, এরকম।’
‘হুহ, গাধা তুমি। তাইলে ভ্যালেন্টাইন ডে, ঈদ, পূজা – এসবও তো শুধু কারো একার জন্য না। সবার জন্য। তাইলে এসব দিনে গিফট দিতে হয় কেন? আসলে ভালোবাসা থাকলে এতো অজুহাত দেয়া লাগে না। আমার কতোদিনের স্বপ্ন আমার বিএফ সব স্পেশাল ডে তে আমাকে উপহার দেবে। জানো সোমার বিএফ কি করছে?’
‘ইয়ে পরে শুনবো এখন বাসায় যেতে হবে একটু, কাজ আছে। টাটা!’
‘বাই, কালকের কথা ভুইলো না। লাভ ইউ। উমমাহ!’
বাসায় ফিরে কাগজটা খুলে ছোটোখাটো একটা হার্ট এটাক হলো ছেলেটার। বছরের প্রতিটা দিনেই কোনো না কোনো বিশেষ দিবস আছেই। কাগজটাতে সুন্দর ভাবে একদম সিরিয়ালি তারিখ-সহ তালিকা করা-
‘জাতীয় কর দিবস।’
‘বিশ্ব বার্গার দিবস।’
‘ক্ষুদ্রঋণ দিবস।’
‘আন্তর্জাতিক মশা দিবস।’
ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
ছেলেটার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। গ্রামের জমিজমা সহ নিজের সমস্ত সম্পত্তি এমনকি দুইটা কিডনি, চোখ, আর ফুসফুস বিক্রি করলেও এই মেয়ের সাথে মাস দুয়েকের বেশি রিলেশান রাখা পসিবল হবে না। কিছু একটা করতে হবে এবং সেটা আজ রাতেই। অনেক চিন্তাভাবনা করে ছেলেটা মেয়েটাকে কল দিলো;
‘হ্যালো বাবু কি করো?’
‘এইতো মাত্র ডিনার শেষ করলাম, তুমি ডিনার করছো?’
‘আমার কি আর গলা দিয়ে ভাত নামার অবস্থা রাখছো তুমি!’
‘মানে, কি বলো।’
‘না এখনো খাইনি, একটা কথা বলি?’
‘হুম বলো।’
‘আই লাভ ইউ বাবু!’
‘আই লাভ ইউ টু জান!’
‘জানো, আমার সেই ছোটবেলা থেকেই গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে একটা স্বপ্ন ছিলো। আশা ছিলো আমার একদিন প্রেম হবে আর আমার জিএফ আমার স্বপ্ন পূরণ করবে।’
‘হুম বলো বাবু। আমি অবশ্যই পূরণ করবো। কি আশা? ঐ টাইপের কিছু নাকি? রুমডেট, হুম?’
‘আরে নাহ এসব না। আমি তখন ছোট, আমার এক আন্টি তার প্রেমিককে খুশি করার জন্য ব্লেড দিয়ে নিজের হাত কেটে সেখানে প্রেমিকের নাম লেখে। আন্টি ঐ ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসতো। সেই থেকে আমার শখ, আমার প্রেমিকাও একদিন আমাকে খুশি করার জন্য নিজের হাত কেটে আমার নাম লিখবে।’
‘কিহ, কি বলো তু তুমি এইসব?’
‘হুম বাবু। তুমিই বলো মানুষ কি তার গার্লফ্রেন্ডের কাছ থেকে এইটুকু চাইতে পারে না? নাকি স্বপ্ন দেখাও দোষ! আর আমি তো জানি তুমি আমাকে আমার সেই আন্টি, আঙ্কেলকে যতটা ভালোবাসতো তার থেকেও হাজার গুন ভালোবাসো। চাইলে তুমি আমার জন্য সুইসাইডও করতে পারো!’
‘সু সু সুইসাইড!’
‘আরেহ এটা করা লাগবে না। শুধু হাত কেটে নাম লিখলেই চলবে। তবে আমার একটা শর্ত আছে।’
‘কি শর্ত।’
‘হাত কাটার মতো এই স্পেশাল কাজটা তুমি অবশ্যই খুব স্পেশাল একটা দিনে করবা। আচ্ছা কালকে তো একটা স্পেশাল দিন। জাতীয় ট্যাক্স ডে। তাই না?’
মেয়েটা আমতা আমতা করে বললো, ‘না মানে আসলে আমাদের এই দিনটা পালন করা ঠিক না। বর্তমানে গরীবের কষ্টের টাকার ট্যাক্স নিয়ে মন্ত্রী এমপিরা বড়লোক হচ্ছে। আমাদের এই দিবস বর্জন করা উচিত।’
‘ঠিক বলেছ, অবশ্যই বর্জন করা উচিত। তাইলে তার পরদিন? বিশ্ব বার্গার ডে।’
‘আরেহ আমি তো বার্গার পছন্দ করি না। সো এই দিন আমি পালনও করবো না।’
‘ওহ, তাইলে পরশু ক্ষুদ্রঋণ দিবস।’
‘উহু, ওটা শুধুমাত্র গরীব ব্যাবসায়ীদের জন্য।’
‘আন্তর্জাতিক মশা দিবস?’
‘অবশ্যই না। মশা আমাদের জন্য খুব ক্ষতিকর!’
বছরখানেক পর।
এক রাতে ছেলেটা মেয়েটাকে নক দিলো।
‘আগামীকাল কিন্তু খুব স্পেশাল একটা দিন। ভ্যালেন্টাইন ডে। আই অ্যাম সো এক্সাইটেড।’
‘ছি! বাবু ছি!’ মেয়েটা রাগ দেখালো। ‘এইসব বিদেশি সংস্কৃতি আমি মোটেও পছন্দ করিনা তুমি জানো না? যারা এই ধরনের আজাইরা দিবস পালন করে তারা মানুষ হিসাবে সবাই ফালতু টাইপ। কোনো রুচিশীল মানুষেরই উচিত না এই দিনটা পালন করা। ওকে?’
‘হুম আসলেই উচিত না!’ – মুচকি হেসে সম্মতি জানালো ছেলেটা।’
আপনার মন্তব্য লিখুন