অণুগল্প

চিরস্থায়ী প্রেম বন্দোবস্ত

স্কুল জীবন

তখন স্কুলজীবনের শেষদিক। পাড়ার রকে, ভাঙ্গা প্রাচীরের মাথায় বসে কিছুটা লুকিয়ে, কিছুটা বুক ফুলিয়ে বিড়ি ফুকা আর সুন্দরীকূল দেখার অধীর বাসনায় কাটে প্রহর। আমাদের বন্ধুগংদের নিজস্ব গ্রুপ সংগীত ছিল; সকলে হেড়ে গলায় সমস্বরে,তালে বেতালে, সারমর্ম বুঝে, কেউ কেউ না বুঝে গেয়ে উঠতাম রবিবাবুর গান হয়েও তারো থেকে মোদের আপন করে নেয়া সংগীত,

মায়াবন বিহারিনী হরিণী গহন স্বপন সঞ্চারিণী
কেন তারে ধরিবারে করি পণ অকারণ …”

ধীরে ধীরে যৌথ প্রযোজনার সঙ্গীত এককে রুপান্তরিত। প্রেম, ভালোলাগা, ভালোবাসা বিষয়গুলো অনুভবের ক্ষমতা কিছুটা হলেও তো হয়েছে। ‘মায়াবন বিহারীনি হরিনী’র মতন রঙ্গ নটিনী শ্যামা যে করেছে আমায় আকুল পাগলপারা। পাগল হলো ছন্নছাড়া স্কুলপড়ুয়া। এই আমি কিশোর প্রেমিক। প্রেমের লাগি যেন জীবন দিতেও পারি, প্রস্তুত তো সদাই। শ্যামাঙ্গিনী যদি হয় মায়াবিনী হরিণী, সদ্য যৌবন আরম্ভ করা এ সখার মনটাও তো তেজোদৃপ্ত বলগা হরিণ। কি করেই বা একে যায় বেঁধে রাখা !

হায়, এবারে শ্যামা যে ছুটতে শুরু করেছে বেদিক, বুঝি মহেন্দ্র নিন্দ্রিত কান্তিপুরুষ পানে, বজ্রসেন অভিমুখে। রহস্যময়ী শ্যামার মায়া হরিনীর রূপ ভেসে উঠে ক্ষনে অক্ষনে, এই কচি কিশোরের প্রেমজর্জরিত বুককে ব্যথাতুর বানাতে। সে বিনোদিনী হায়, ফিরেও না চায়। দৃষ্টি আকর্ষণের এতশত মহাজাগতিক চেষ্টা হায়, তবু না। তবুও নারে ভাই।

তাহলে প্রাপ্তিযোগ! একেবারেই কি শূণ্য! শুধু ব্যর্থতা আর বিফলতা!

স্কুলপড়ুয়া কিশোরের তনুমন ধেনু গাইতে শুরু করে সে হরিনী ধরিবার বিরহ সঙ্গীত।সে প্রিয়েকে দেখতেই, কালাপাহাড় সমান ওজনদার দুঃখও হাল্কা দমকা হাওয়াতেও ভেসে উঠত; বেজে উঠত চিরদুঃখ সঙ্গীত, কবিগুরুর মতো এই কোমলমতি হৃদয়েও বেজে উঠত,

কেন তারে ধরিবারে করি পণ- অকারণ।

এখনি মনে হতো, নো পাত্তা দেয়াদেয়ি। আবার একটু পরে বাজতে শুরু করে,

মায়াবন বিহারীনি
থাক থাক নিজ মনে দূরেতে
আমি শুধু বাশরীর সুরেতে।”
স্কুল থেকে কলেজে যাচ্ছি প্রেমহীন হৃদয় নিয়ে।

কলেজ জীবন

স্কুলজীবনে তাড়া শুরু করা সেই মায়াহরিণী শ্যামা কিশোর এই হৃদয়কে শুধু স্কুলেই না কলেজে গিয়েও ক্ষতবিক্ষতই করল শুধু। ব্যথা রে, ওরে ব্যথা! বিক্ষত অন্তর ধারণ করে স্কুলজীবন শেষ হয়েছিল, হলো কলেজ জীবনটাও সেভাবেই শেষ। প্রেম আর হলো না। হবেই বা কি করে সে যে এলোইনা, দিলোও তো না ধরা। বাঁশির করুণ সুরের রসাস্বাদনই যেন মোর প্রেম, ব্যথার বেদন, অগ্নিবীণা। একলা একাই বাজল সে বাশিও কিছুদিন; তবে সে পাষাণিনী শ্যামাঙ্গিনী ফিরেও তাকালো না একবারো। অধরা সে ‘প্রেম অপ্রাপ্তি’ খোল-নলচে বদলে কলেজে গিয়ে পুনর্বার পুনৌদ্যোমে নবপ্রেমে পতন। তারপর? পতনই শুধু তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ, উত্থান আর স্পর্শ করা হয়নি। বরাবরের মতোই, চিত্ত আকুল হলো অনুক্ষণ, চমকি উঠল ফাগুনের পবন।

– হায় প্রেম। আহা প্রেম! আহা।

এবারেও সে প্রেম এলো টগবগিয়ে, রেসের কালো ঘোড়ার পিঠে করে। বীর সেনানী আবারো ভূপাতিত ধ্বপাস, সপাটে ধরাশায়ী, কিছুটা সজ্জাশায়ীও। সে তো আর দায়িত্ব শ্যামা’র নয়, তাকে টেনে তুলে! বরং পারলে তো আরো জোরে নীচে দেয় ঠেলে। ধরাশায়ী হয়েও তবু ভাঙেনি মম হাত-পা, কিছুটা ক্ষত তবু প্রেমবাসনা হৃদয়ের ছিন্নপত্র আসনে মহা ত্যাজে মহীয়ান হয়ে আসিত। খেমটা এক ঝাটকাতে আবার “না”; মানে একেবারে না, চরম পরম ঘাড়ধাক্কা।বারবার ‘না’ আর না। শুনেই চলেছি না, তবে কি প্রেমবাসনা স্থায়ীভাবে আসন গাড়তে বসেছে, হয়ে বেদনা! তারা করতেই থাকুক, আমার চেষ্টাও থামাব না-

– পরশ করিব ওর প্রাণমন – অকারণ
মায়াবন বিহারীনি
চমকিবে ফাগুনেরও পবণে
পশিবে আকাশবাণী শ্রবণে ।।
চিত্ত আকুল হবে অনুক্ষণ – অকারণ
দূর হতে আমি তারে সাধিব
গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব ।।
গোপনে বিরহডোরে বেঁধে চলি আজো অনুক্ষন।”

-মেহেদী হাসান তামিম