জীবনের গল্প

জীবনের গল্প : ফেলে আসা দিন ও আজ-১ || ✍ পিতাম্বর ধনঞ্জয় ঘোষাল

কত কথাই যে আজ মনে ভিড় করে আসছে -সেই ছোট বেলা থেকে আজ পর্যন্ত কত ঘটনার ঘন ঘটা তা যদি লেখার আকারে প্রকাশ হতো তাহলে হাজার পাতার একটি বৃহৎ আকারের গ্রন্থ হয়ে যেত।

কি করে লিখি ? লেখা মানেই তো জ্বলন্ত সত্যি কথা গুলো বলতে হবে! কত বঞ্চনা,কত অপমান ,কত কলঙ্ক –এগুলো লিখে কি লাভ হবে? কিন্তু এ গুলোই বাস্তব জীবনে ঘটেছে।

 

সেই যে হৃষ্টপুষ্ট দিদি –যাকে আমি চিনতামই না কোন দিন –যে পেশায় একজন শিক্ষিকা। সেই দিদিভাই পৌষের রাতে আমাকে যে ভাবে সেক্সুয়ালি হয়রান করেছিল -তা তো ভিভিডলি বলা যাবেনা।

একটি সতেরো বছরের নবীন কিশোর কাম বাসনার ঊর্ধ্বে -তাকেও ঐ অবস্থায় পড়তে হয়েছে।

 

সাধারণত বিদ্যালয় গুলিতে শুধুমাত্র যে ছাত্ররা পড়া শুনায় ভালো বা যে ছাত্রী গুলি একটু ডাগর ডাগর স্যাররা সদা সর্বদা তাদের উপর কৃপা দৃষ্টি দিয়েছেন।

এগুলি কোন বানানো বা প্রতিহিংসা নেবার জন্য বলছিনা।

যখন কমিউনিস্ট হওয়াকে গর্বের মনে হতো -তখন গ্রামের কোন বাড়িতে মার্কস বাদ লেনিন বাদ –স্লোগান লিখতে গিয়ে কতো যে অশ্রাব্য গালিগালাজ খেয়েছি !

এখন মনে পড়লে চোখ দিয়ে জল আসে! কেন জল আসে ? তখনতো রঙ কেনার পয়সা ছিলোনা তাই মায়ের আলতার শিশি চুরি করে খেজুর ডাল ভেঙ্গে দাঁত দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে ব্রাশ বানাতাম –তারপর মার্কসের মতবাদ লিখতাম। ফল স্বরূপ আমার কোনো চাকরি হলো না। কারন আমি বামপন্থী। হায় ঈশ্বর ! আমি তখন ডান বা বাম পন্থা বুঝতামই না। চাকরি তারাই পেল যারা পড়া শুনো কখনো করেনি কিন্তু–ওই যে ডান !

অতএব ইউথঅরগানাইজার বা বি এল আর ও অথবা ফরেস্ট অফিসার এবং প্রাথমিক শিক্ষক।

আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই থেকে গেলাম।

তারপর ইতিহাসটাই পাল্টে গেল। তখন ডান আর কেউ নেই, সব বাম। আর আমি কি করে যে ডান হয়ে গেলাম আজো বুঝলামনা। প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে গেলাম।আমার তখন পঁচিশ। আমি একজন বাম মন্ত্রী কে জিজ্ঞেস করে বসলাম –তাহলে সর্বহারার শ্রেণী সংগ্রাম কোথায় ? তাহলে ক্ষমতায় সর্বহারাদের প্রাধান্য কোথায় ?

 

অতএব ;—-

চাকুরী জীবনে যা দেখলাম সে তো আরো ভয়ংকর। দেখলাম দু রকম প্রাণী আছে –একরকম – রাজার মতো , আরেক দল–জী হুজুর ।

ব্যস্ হয়েগেল। আমি তো আমি। আমি তখন মদের ঘোর থেকে বেরুতে পারিনি ,হ্যাঙ্গওভার কাটেনি ! তাহলে আর্নেস্তো চে গুয়ে ভারা,মার্কস ,লেনিন, এ্যান্গেল, ফিদেল কাস্ত্রো ,পাবলো নেরুদা, এরা সব ম্রিয়মান হয়ে দেয়ালে ঝুলছে কেন ?

 

এই এক দোষ আমার কি দিয়ে শুরু করলাম আর কোথায় নিয়ে যাচ্ছি ।

আমার তো গ্রামে বাড়ী। মাটির দেয়াল খড় দিয়ে ছাওয়া , উঁচু বারান্দা কারন নদীর কিনারে বাড়ী । বর্ষাকালে বানের জল যাতে ঘরে ঢুকে না যায় । মস্ত উঠোন। গোবর দিয়ে নিকানো ।পূর্ব দিকে একটা তুলসি মঞ্চ । মা রোজ স্নান করে পুজো করত , সন্ধ্যে বেলায় সন্ধ্যা প্রদীপ

জ্বালাতো। আমি মা -র ছোট ছেলে হবার সুবাদে খুব আদরের ছিলাম। আর তাছাড়া আমি মায়ের খুব ন্যাওটা ছিলাম। এক কথায় মায়ের ছেলে ছিলাম।

 

গ্রামের ছেলে । খেলা গুলোও ছিল গ্রামের খেলা । ডাংগুলি , মার্বেল খেলা,লাটিম ঘোরানো , ঝোড়ল ঝাঁপ

কিত্ কিত্ ,কানামাছি এই সব আর কি !

হ্যাঁ আরেকটা খেলা খেলতাম বৌ বর খেলা। বিনি সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠতো –“আমি তোর বৌ হব” —

আহা! কি সুখের দিন ছিল -মনে পড়লে বুকটা কেমন নেচে ওঠে ।

 

এভাবেই কখন অষ্টম শ্রেণী পাশ হয়ে গেলাম। তখন আমাদের গ্রামের ইস্কুল জুনিয়র হাই ইস্কুল ছিল , অর্থাত পঞ্চম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী। এরপর নাইনে পড়তে হলে হয় বাঁকুড়া শহরে নয় আমাদের গ্রাম থেকে সাড়ে তিন কিলো মিটার দূরে হাই ইস্কুলে পড়তে হবে । আমাকে ওই সাড়ে তিন কিলো মিটার দূরের ইস্কুলেই ভর্তি করা হল । অথচ বাঁকুড়া শহর আমাদের গ্রাম থেকে অনেক নিকটে । তবুও বড়দার বক্তব্য অনুযায়ী শহরের ইস্কুলে পড়লে বিড়ি সিগারেট খেতে শিখে যাবো। সিনেমা দেখবো ,পড়াশুনো কিচ্ছু হবেনা ।

অতএব ওই সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরের ইস্কুলেই ভর্তি হতে হলো ।

ক্লাস নাইন থেকে ইলেভেন -এই তিনটে বছর আমার জীবনে নরক যন্ত্রণার চেয়ে কিছু কম ছিলনা । একে তো নতুন ইস্কুল ,নতুন টিচার, বন্ধুরাও নতুন ।তার উপর হেড স্যার আমার জীবনে যম দূতের মতো আবির্ভূত হলেন। কারনে অকারনে আমাকে অপদস্থ করা , ডাস্টার দিয়ে মারা আর সবার চেয়ে যেটা আমাকে যন্ত্রণা দিত তা হলো হেড স্যারের গ্রাম্য ভাষায় অপমান এবং নানা রকম মুখ ভঙ্গি করে অপমান । যেহেতু ইস্কুলটি কো-এডুকেশন ছিল , তাই মেয়েরাও পড়ত । হেড স্যারের ওই রকম যখন বচন চলত তখন ওরা সবাই মুখ চেপে হাসতো । তখন আমার মরে যেতে ইচ্ছে হত । কতবার আমি আত্মহত্যার কথা ভেবেছি । হেড স্যারের মৃত্যু কামনা করে পাঁঠাও মানত করেছি । কিন্তু না ! উনি মরেননি আর আমার পাঁঠাও দিতে হয়নি ।

এভাবেই চলছিল এক অবোধ কিশোরের জীবন। আনন্দ বলতে শুধু ছিলো ইস্কুল থেকে লাল মোরামের পথ বেয়ে যখন আসতাম । দু দিকে ধু ধু মাঠ আর মধ্যি খানে লাল কাঁকুরে রাস্তা। ফেরার সময় রাস্তার পাশে একটা মস্ত আশ শেওড়া গাছের তলায় রোজ দাঁড়াতাম। আমার এতো ভালো লাগতো যে ইস্কুলের সব দুঃখ ভুলে যেতাম। গাছটা এমন ছড়িয়ে ছিলো যে এক ঘন্টা বৃষ্টি হলেও গাছের তলায় দাঁড়ালে ভিজতাম না একটুও। আমার বেশ লাগতো। আর একটা লোভনীয় ব্যাপার ছিলো–ওই ফাঁকা মাঠ গুলোয় বন কুলের ছোট ছোট গাছ। প্রাণ ভরে কুল খেতাম আর নিয়েও আসতাম পকেট ভর্তি করে।

 

আর ছিলো দুটো ছোট নদী। আমাদের ওখানে অবশ্য ওগুলোকে জোড় বলে। বর্তমানে আমি যেখানে থাকি এখানে বলে কাঁদো। যাই হোক প্রতিদিন আমাকে ওই দুটো জোড় পেরিয়ে স্কুল যাতায়াত করতে হতো।

 

এ ভাবেই আমার হায়ার সেকেন্ডারি শেষ হলো এবং হেড স্যারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যারপরনাই আনন্দ পেয়েছিলাম। এরপর কলেজ। আমার আবাল্য স্বপ্ন বাঁকুড়া খৃষ্টান কলেজে পড়ার।

সৌভাগ্যবশত ভর্তি হওয়ার সুযোগও পেয়ে গেলাম। আর এই কলেজে পড়াকালীন স্টুডেন্ট ফেডারেশনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া।

কিন্তু আমার তখন মাত্র সতেরো বছর বয়স

আমার ও সব ভালো লাগত না। আমি কেবল কমিউনিজমের বই পড়তাম। বলশেভিক আন্দোলন সম্পর্কে একটা ধারণা ছিলো খুব হাল্কা-ধোঁয়াশাছন্ন। পার্টি ইশতেহার পড়ে আমার সেই বয়সে খুব যে ভালো লেগেছিল এমন নয়।

তখন আমি কমিউনিস্ট আন্দোলনের উপর লেখা উপন্যাস পড়তে শুরু করি। সেই সময় আমি যেমন গীতা পড়ছি , জীবনানন্দ দাশ পড়ছি ,বিভূতি ভূষণ পড়ছি সাথে সাথে ম্যাক্সিম গোর্কির মাদারও পড়ছি। শুধু তাই নয় সেই সময়কালে নিকোলাই অস্তভস্কির ইস্পাত পড়ে আমি ভীষণ প্রভাবিত হয়ে পড়ি। পরবর্তীকালে আলেকজান্ডার ফাদায়েভ, দস্তয়ভস্কি এমন কি লুকিয়ে চুরিয়ে রেড বুকও(চটগল্প) পড়তে শুরু করেছিলাম,

শুধু আমার সিলেবাসের পড়া গুলো পড়া হতোনা । ফল স্বরূপ পরীক্ষার ফলও আশানুরূপ হলোনা ।

 

যখন আমার বয়স সতেরো থেকে উনিশ এই দুই বছরে আমার জীবনটাই আমূল পাল্টে দিল নন্দিনী ।

নন্দিনী আমাদের গ্রামের ছিলনা। আমাদের গ্রামে ওর মামার বাড়ি।

নন্দিনী আমারই সমবয়সী। দেখতে ভারি সুন্দর এবং বেশ লম্বা । ও প্রায় আমারই মতো লম্বা ছিলো । ওর বাবা রেলে চাকরি করতো কাজে কাজেই ওরা থাকতো একটি বিখ্যাত রেল সিটিতে । ওর চলা, কথা বলার স্টাইল একদম সিনেমার নায়িকার মতো ।

কিন্তু ওর প্রতি আমার কোন আকর্ষণ ছিলনা কারণ অনেক ছোট বয়স থেকেই আমরা দুজন দুজনকে চিনতাম। কিন্তু এই প্রথম নন্দিনী আমাকে নারীর দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করলো। ব্যাপারটা প্রথমে অতো বুঝতে পারিনি। তাই আমার আলাদা কোন আকর্ষণও তৈরী হয়নি। কিন্ত একদিন বোশেখের দুপুরে আমি পড়ছিলাম কেন না সামার ভেকেশনের পরই আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা ছিলো। নন্দিনী হঠাৎই এলো আমার কাছে । জিজ্ঞেস করলো –“এতো গরমে পড়তে ভালো লাগছে? এখানে তো ইলেকট্রিসিটিও নেই ,বাব্বা আমি গরমে মরে যাচ্ছি “। আমি কিছু না বলে বইটা বুকের উপর রেখে দিলাম। ও আচমকা আমার মুখের উপর ওর মুখ দিয়ে আমার ঠোঁট গুলো খুব করে চুষতে লাগলো।ও পাগলের মতো ছটফট করছিল। আমি প্রথমটায় ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তারপর আমি ওকে জোর করে আমার মুখ থেকে ওর মুখটা সরিয়ে দিয়ে নিচে চলে এলাম। আমার লজ্জায় ঘৃণায় বমি লাগছিলো।

আমি দৌঁড়ে কলতলায় গিয়ে ভালো করে মুখ ধুলাম ,কুলকুচো করলাম অনেকক্ষণ ধরে । আমার জীবনে এই প্রথম কোন বড় মেয়ে এভাবে চুমু দিল এবং এক রকম জোরকরে । আমার খুব খারাপ লাগছিল।

ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছিল যদিও পুরো ঘটনায় আমার কোন হাত ছিলো না ।

 

আমার হাত থাক আর নাই থাক ,আমার সর্বনাশের শুরু সেই দিনই। কারণ এরপর ও যতবার আমাকে একলা পেয়েছে ততবার সেই একই ব্যাপার ঘটিয়েছে। ধীরে ধীরে আমি ওর প্রেমে পড়ে গেলাম। ওকে এক দণ্ড না দেখতে পেলে আমি পাগল হয়ে যেতাম।

আমার আর নন্দিনীর প্রেম তখন চরমে। আমাদের বাড়ীর পাশদিয়ে বয়ে চলা নদী -যাতে বছরে আট মাস জলই থাকত না । আমরা দুজন নদীর বালির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর চলে যেতাম। কত স্বপ্ন দেখতাম? সব রঙিন স্বপ্ন। সন্ধ্যে হয়ে গেলেও আমরা বসে থাকতাম। ও খুব ভালো গান গাইত। আমি ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতাম আর ও একটার পর একটা গান গাইত।

 

সেদিনও আমরা হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে গেছি ! যেখান থেকে আমাদের গ্রাম প্রায় দুকিলোমিটার। কোন মানুষ নেই । শুধুই ধু ধু বালি। সুর্য তখন প্রায় ডুবু ডুবু। খুব কাছেই প্রথমে একটা শেয়াল ডাকলো তারপর অনেকগুলো শেয়াল একসাথে ডাকতে শুরু করলো। ও ভীষণ ভয় পেয়ে আমাকে ঝাপটে ধরল । ও তো শহরের মেয়ে ,ও শেয়াল দেখেইনি ।

আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বালিতে বসালাম– ও তো শেয়াল ডাকছে –ওরা কিছুকরে না। আমাকে শক্ত করে ধরে বাচ্চা মেয়ের মতো করে বলল –সত্যি কিছু করবে না ? আমি ওকে আরো শক্ত করে ধরে ওকে চুমু খেলাম অনেকক্ষণ ধরে । ওর তখন নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা।

আমি ওকে ছেড়ে দিলাম। ও একটু রেগে বলল আমার লাগেনা বুঝি ? আমি মুখে কিছু না বলে সটান ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে বললাম একটা গান শোনাও । দেখ্ কেমন জ্যোৎস্না ! পুরো দিনের মতো লাগছে না ?

ও একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত শুরু করলো –“আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে–

যাবো না —

যাবো না গো যাবো না যে রঙিন পরে

ঝড়ের মাঝে এই নিরালায়

এই নিরালায় রব আপন মনে

যাবো না এই মাতাল সমীরণে

আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে ।

 

আমার এই ঘর বহু যতন করে

ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে

আমারে যে জাগতে হবে

সীতানে সে আসবে কবে

যদি আমায় —

যদি আমায় পড়ে তাহার মনে

বসন্তের এই মাতাল সমীরনে -আজ

জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে ॥

 

বেশ রাত হয়ে গেছে। সারা নদীর বালু জ্যোৎস্নায় ভাসছে । স্পষ্ট দিনের মতো বহু দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে । এই ছায়াহীন উদাস গম্ভীর বালুচরের জোছনায় কে প্রেম করেছে আমি জানিনা—সেই জ্যোৎস্না মাখা বালুচরে নন্দিনী আর আমি –কেউ ছিলনা

সেথায় ছিলাম আমরা দুজন আর ছিল

এই নদী। আমি জীবনেও ভুলবনা সেই রাতের কথা। নন্দিনীর গাওয়া রবীন্দ্র সঙ্গীত উন্মুক্ত আকাশ তলে বালুচরের

জ্যোৎস্নায় আমরা সব ভুলে গিয়েছিলাম। আমার জীবনের সব চাইতে ভালবাসার মুহুর্ত ।

 

চলবে……………

 

পশ্চিমবঙ্গ,ভারত