১৯৬১ সালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও প্রিন্স ফিলিপ (ডিউক অফ এডিনবার্গ) যখন তাঁদের পূর্ব পাকিস্তান সফরের অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন, তখন সমবেত জনতার মধ্যে আমিও বাবার সঙ্গে সিআরবি পাহাড়ের ঢালে (প্রথম ছবিতে যে জায়গাটি দেখা যাচ্ছে, মনে হয় তারই কাছাকাছি) দাঁড়িয়ে তাঁদের দেখেছিলাম। মাত্র কয়েক হাতের ব্যবধানে তাঁদের গাড়ি বহরে প্রথম খোলা জিপটিতে গভর্নর আজম খানের পাশে দাঁড়িয়ে তরুণী রানী তাঁর সাদা দস্তানা পরা হাত নাড়ছিলেন, এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে। দ্বিতীয় জিপটিতে ছিলেন প্রিন্স ফিলিপ। তাঁর পাশে কে ছিলেন? মিসেস আজম খান কি? নাকি অন্য কেউ? মনে করতে পারি না। হয়তো ভালোভাবে লক্ষ্য করিনি। সবার চোখ তখন রানীর দিকে। তখন তাঁর বয়স ৩৫। আর আমি ৮ বছরের বালক। এর আগে বইপত্রে রাজা-রানীর কথা পড়েছিলাম। সেদিনই বাস্তবের এক রানীকে (যদিও মুহূর্ত কয়েকের জন্য) প্রায় কাছ থেকে দেখলাম। সেটাই প্রথম আর সেটাই শেষ। রানী তো চট্টগ্রাম বা পূর্ব পাকিস্তান সফর করে ফিরে গেলেন। কিন্তু এরপর কিছুদিন আমার এবং আমার সে সময়ের সহপাঠিনী ও খেলার সাথী ফাতেমা বেগম রেখার বিকেল বেলার একটা মজার খেলা হয়ে দাঁড়ালো রাজা-রানী সাজা, একটা উঁচু চেয়ারকে গাড়ি বানিয়ে তার উপর দাঁড়িয়ে অদৃশ্য জনতার উদ্দেশে হাত নাড়া। খেলাটা বোধ হয় বন্ধ হয়েছিল একদিন আমাদের কেউ একজন বা দুজনই চেয়ার উল্টে পড়ে যাওয়ার পর মায়ের বকুনি খেয়ে।
সেদিন রানী এলিজাবেথের গাড়ি বহর আমাদের সামনে দিয়ে অতিক্রম করার কিছুক্ষণ আগে একটা লোক বিচিত্র রঙের পোশাক পরে ও রণপা পায়ে সমবেত জনতাকে তার শারীরিক কসরৎ দেখাচ্ছিল। সেদিনই প্রথম রণপা জিনিসটির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। কৌতূহল থেকে বাবাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। আজ মাঝে মাঝে মনে হয় ধীরে ধীরে অগ্রসরমান একটা খোলা গাড়িতে রানি, রাজা বা দেশী-বিদেশী কোনো রাষ্ট্রপ্রধান দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে নাড়তে যাচ্ছেন, নিরাপত্তার দায়িত্বে রাস্তায় কেবল কিছু পুলিশ মোতায়েন আছে, রানির গাড়িবহর যাওয়ার সামান্য আগে সেখানটাতেই একজন লোক সং সেজে জনতাকে আমোদিত করছে, আজকের দিনে পৃথিবীর কোনো দেশেই কি এটা আর সম্ভব? আজকের দিনে হলে তো রানী আসার আগেই তাঁর নিজ দেশ থেকে চারদিক ঢাকা বুলেটপ্রুফ গাড়ি নিয়ে আসা হতো। রানী এলিজাবেথের পাকিস্তান সফরের বছর খানেক আগেই, ১৯৬০ সালে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু পাকিস্তান সফর করেন। সে-সময় করাচির রাস্তায় খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে দু-পাশে সমবেত জনতার উদ্দেশে নেহেরু আর আইয়ুব খানের হাত নাড়ার দৃশ্য তো ছবিতে দেখা যায়। অবশ্য রানী ও প্রিন্স ফিলিপের পাকিস্তান সফরের মাত্র দুবছর পরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি তাঁর নিজ দেশেরই টেক্সাস রাজ্যের ডালাস নগরী সফরকালে খোলা গাড়িতে দাঁড়ানো অবস্থায় আততায়ীর ছোড়া দূরপাল্লার রাইফেলের গুলিতে নিহত হন। গত ছয় দশকে পৃথিবীর নিরাপত্তা ব্যবস্থার বলা বাহুল্য আরো অবনতি হয়েছে।
নিরানব্বই বছর বয়সে প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুকে পরিণত বয়সের বিদায়ই বলতে হবে। তাঁর মৃত্যুসংবাদ আমাকে আমার ছোটবেলায় সেই রানী ও রাজপুরুষ দেখার সামান্য স্মৃতি মনে করিয়ে দিল। সেই স্মৃতিচারণ এবং সে প্রসঙ্গে কিছু কথা দিয়েই আমি প্রয়াতের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম।
আপনার মন্তব্য লিখুন