জীবনের গল্প রঙের জীবন

বাদামওয়ালা-৩

ঘুম নেই চোখ লাল, তবু থাকি জেগে
নীল আকাশ থৈ থৈ,ভেসে আসা মেঘে…

হাটছি আনমনে হাটার গতি শ্লোথ হয়ে আসে,পকেট হাতড়িয়ে দুই টাকার নোট। নিরব যন্ত্রণায় পড়ে থাকে জীবিকার আর্তনাদ। বড় ভাইয়ের দেয়া বিশ টাকার শেষ অজুহাত। কে ফিরিয়ে দিবে আমায়, আমার ভোর হওয়া অতীত সব।

হক দের গেটে দাঁড়িয়ে থাকি রোজ, দেখি লাল নীল স্বপ্নের উৎসব। তবু কেউ দেয়নি আমায়, আমায় গড়িয়ে আমার ভবিষ্যৎ। আমি বেমালুম ভুলে যাই নিজের কথা, মনে পড়ে যায় পরিবার আজ কিছু খেলো কিনা? আক্রোশে হেসে উঠিনা, হইনা উম্মাদ ক্ষুধার জ্বালায়, ক্ষুধার্ত চোখ তবু খুঁজে শান্তির পায়রা।
::
গার্মেন্টস এর গেটে ক্ষুধার্ত মানুষের ভীড়, এগিয়ে যাই আমি হাতে ফাইল বন্দী সার্টিফিকেট। কেউ একজন আমায় ইশারা করল, এগিয়ে গেলাম। ভাবলাম চাকুরীটা বুঝি হবে…না হল না।সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে দারোয়ান ইনচার্জ বার বার আমার মুখের দিকে তাকাতে লাগল। এমন ভাবে তাকাতে লাগল মনে হয় আমি যেন কি চুরি করেছি?

প্রশ্ন করে বসল”এ সার্টিফিকেট কার? এ রাজ্যে আমি অসহায়, নিজেকে নিজে চিনিনা আমি তাইতো আমি জলাঞ্জলি রূপ। সার্টিফিকেট এর রেজাল্ট আমার চাকুরী টা হতে দিলনা। উনি সাফ বলে দিল বাপু, ‘এতো ভাল রেজাল্ট তোমার দ্বারা এ চাকুরী সম্ভব নয়! আলবৎ সম্ভব স্যার। না বাপু কয়েক দিন পর চলে যাবে পরে আমি বিপদে পরতে পারবনা।
::
বসে আছি বলে বাসার মালিক তার মেয়েকে প্রাইভেট পড়াতে বলল। আমি সানন্দে গ্রহণ করলাম, মনে আশার সঞ্চার হল যাক কিছু টাকা তো পাওয়া যাবে। যদিও অনেক পড়ে জানতে পারি যে এই প্রাইভেট পাবার ব্যাপারে বড় ভাইয়ের অবদান পুরোটাই।যদিও বড় ভাই আমাকে জানায় নি। অফ সিজন কাজ নেই তাই বড় ভাই বাড়ী চলে গেলেন।

যাওয়ার সময় হাতে একশো টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিয়ে গেলেন। এই একটা মানুষের কাছে আমি সারাজীবন ঋণী হয়ে আছি। নিজের কাছে না থাকলেও উনি সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন আমাকে দেয়ার। বাবা আমাকে শাসন করতেন, পড়তে বলতেন নিজেও সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন যাতে আমি পড়াশুনা টা চালিয়ে যাই। টাকার বেশীর ভাগ যোগান বড় ভাই দিতেন। উনি নিজের পড়াশুনা বিসর্জন দিয়ে সংসারের হাল ধরেছেন।

আমাদের মানুষ করবেন বলে। অন্য কাজ করতে গেলেও বড় ভাই করতে দিতেন না। নিজে শার্ট না কিনে আমাকে কিনে দিতেন, নিজে না খেয়ে নিজে খাওয়ার কথা বলে খাওয়াতেন। নে ভাই খা, আমি খেয়েছি।

বলতেন আমি আছি তো, এতো ভেঙে পড়িস কেন? নিজের প্রতি কনফিডেন্স রাখ, এই দিন একদিন থাকবেনারে পাগলা। মুখে একটা সব সময় নির্লিপ্ত হাসি লেগেই থাকত ওনার বুঝতে পারতাম এ হাসি বড়ই কষ্টের, বড়ই বেদনার। এ হাসির দাম আমার কাছে অমূল্য।
::
যথারীতি মাস শেষ, প্রাইভেট এর বিল পাওয়ার দিন আজ,বেশ খুশিই লাগছে। শহরের প্রথম ইনকাম বলে কথা। বহু প্রতিক্ষার পর বেতন পেলাম। অনেক টাকা, এ দুর্গতি আর দুর্মূল্যের বাজারে এ টাকার মূল্য যে অনেক। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে মুখে তবু হাসি রেখে রুমে ঢুকে পড়ি।

ভেবে রাখা খরচের তালিকাটায় কাঁটাছুরি চালাচ্ছি বারবার। বড় ভাই বলল কিরে বেতন পেয়েছিস?এক চিলতে হাসি দিয়ে বললাম পেয়েছি? কত পেয়েছিস উত্তরে চুপ হয়ে রইলাম। আমি নির্বাক, নিস্তব্ধতা আমায় গ্রাস ফেলছে তবু বললাম দিয়েছে ভালই খারাপ না, ১০০ টাকা।

বড় ভাই আমার ঘাড়ে একটা হাত রেখে বলল ভাই এটা ১০০ টাকা নয়রে এটা ১ লক্ষ টাকার সমান। এই একশো টাকাই তোকে পথ দেখিয়ে নিবে। চোখের কোন দিয়ে টপ করে এক ফোঁটা জল পড়ে গেলো। সান্ত্বনা যে কত বড় জিনিস এই প্রথম খুব কাছ থেকে দেখলাম।

#নিচু তলার উকিল