অণুগল্প

বিন ওয়ালিদ কোম্পানির দিলদার খান

একটু রাত করেই ক্যাম্পে ফিরলো জানে আলম ।সিগ্রেটের আয়েশী টান থেকে বোঝা যাচ্ছে নৈশভোজনটা বাইরেই সারা হয়ে গেছে দেশি আড্ডাবন্ধুদের সাথে।এখন দেশি লোক ম্যালা জেদ্দায়।শুধু জেদ্দা কেন, পুরো সৌদি আরব – এমন কি মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোয় বানের পানির মতো লোক আসছে গরিব দেশগুলো থেকে।স্বনামে, বেনামে, গলাকাটা পাসপোর্টে, ওমরাহ্‌ ভিসায় – কতভাবে যে আসছে তারা দালালের হাত ধরে, সোনার হরিণের মোহে। দালালের মাধ্যমে আসতে গিয়ে কারো কপাল খুলেছে, কারো জমিজিরেত সবই গেছে।

আজ শুক্রবার – ছুটির দিন। তাই ভিনদেশি মিসকিনদের জটলা এখানে ওখানে সবখানে। সৌদিরা আত্মশ্লাঘার সাথে বিদেশি কর্মিদের মিসকিন ডাকে। আস্‌সালাম, আন্দালুস ইত্যাদি শপিং মলের সিঁড়ির গোড়ায় কিংবা সাগরঘেষা পার্কে বসে প্রাণ খুলে নিজের ভাষায় কথার খই ফুটাচ্ছে তারা ছোট ছোট আড্ডায়।প্রথম যারা বিদেশবিভূঁইয়ে এসেছে এদের অনেকেই সমুদ্র দেখেনি কোনদিন; এমনকি নিজ দেশের রাজধানী শহরটাও দেখা হয়নি বিদেশযাত্রার আগের দিন পর্যন্ত । এরা আবার বেশি আগ্রহী লোহিত সাগরের পাড়টা ঘুরে দেখতে; পুরনো রাজধানী শহরটা সাগরের পার ঘেঁষেই। ছুটির দিনের এসব উৎসব উৎসব আড্ডাবাজি শেষ হয় দেশি রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খাওয়ার মধ্য দিয়ে।

খুব সাবধানে চাবি ঘুরিয়ে রুমের দরজা খুললেও দিলদার খানের পাতলা ঘুম যে ভেঙ্গে যাবে এটা অবধারিত।তাছাড়া শরীরটাও ইদানীং গাদ্দারি করছে বলে ঠিকমতো ঘুম হয় না তার।বিন ওয়ালিদ কোম্পানির বিশাল ডাইনিং হলে সবার সাথে খাওয়াদাওয়া শেষ করে রাত দশটার আগেই প্রতিদিন শুয়ে পড়ে দিলদার খান।কোম্পানীর সিনিয়র সিকিউরিটি সুপারভাইজার হিসেবে এই ছোট রুমটা তার জন্য বরাদ্দ।পাঁচশোর মত নির্মাণকর্মি,পঞ্চাশজন নিরাপত্তা প্রহরী আর সুপারভাইজার/ফোরম্যান পদমর্যাদার কিছুসংখ্যক লোকের জন্য ক্যাম্পে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে সৌদি আরবের এই বিশাল ইমারত নির্মাণ প্রতিষ্ঠান।

জানে আলমের আসার শব্দ পেয়ে পাশ ফিরতে ফিরতে ঘড়ঘড়ে গলায় দিলদার খান বলে, ‘আবি আয়া’– প্রশ্নও নয়, কৈফিয়ত তলবও নয়। এটা স্রেফ একটা গৎ।

‘জ্বি ওস্তাদ, দেরি অইয়া গেল, কুই বাত নেহি, আমি আবি আবি সু জাওঙ্গে।‘ জানে আলম খিচুড়ি ভাষায় জবাব দেয়।এতে কোন অসুবিধা নেই।দু’জনই এভাবে বাতচিত করে, বোঝেও।এখানে কতো দেশের লোক আছে। সবাই বিভিন্ন দেশের ভাষার সাথে অল্প অল্প পরিচিত।দিলদার খানের ষোল বছরের প্রবাসজীবনে সে আরো বেশি অভিজ্ঞ।সেই আশি সালে তার আসা, চাকুরিও করছে একই কোম্পানিতে।আরবির পাশাপাশি বাংলা, তামিল, মারাঠি, ফিলিপিনো অনেক ভাষার কিছু কিছু কথা সে বোঝে, আওড়াতেও চেষ্টা করে মাঝে মাঝে।সে হিসেবে জানে আলম নতুন।মাত্র তিন বছর আগে মুদির দোকান ছেড়ে দিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে মরুর দেশে পাড়ি জমিয়েছে।বলতে হবে কপাল তার ভালো।সুঠাম শরীরের সুবাদে সিকিউরিটি গার্ডের চাকুরিটা পেয়ে গেছে।আর যে কারণেই হোক, সুপারভাইজার দিলদার খানের নেকনজরে পড়ে যাওয়ায় দুই দুইটা ইনক্রিমেন্টও কপালে জুটেছে।বাংলাদেশের বড়লেখার জানে আলমের উপর পাঞ্জাবের ডেরা গাজী খাঁর সুবেদার দিলদার খানের এত মায়া পড়লো কেন এটা রীতিমত রহস্যময় অনেকের কাছে।পুরনো কেউ কেউ বলে, জানে আলমকে দেখলে হয়তো ওস্তাদের আপন কারো কথা মনে পড়ে; আবার অতি সুক্ষদর্শী দু’একজনের মতে ওস্তাদের চেহারার সাথে জানে আলমের কোথায় যেন মিল আছে।তবে যে কারণে সবার ভ্রু বলতে গেলে কুঁচকে গেছে তাহলো পঞ্চাশজন সিকিউরিটি গার্ডের মধ্যে আর কেউ না, জানে আলমকেই ওস্তাদের এমন পছন্দ হলো যে তাকেই তার খাস কামরায় থাকার জায়গা দিয়ে দিলো।হোকনা ফ্লোরে ম্যাট্রেস পেতে থাকা, ওস্তাদের নিরিবিলি নির্ঝঞ্জাট এসি রুমে থাকা ভাগ্যের ব্যাপার।ক্যাম্পের হাউকাউ ধস্তাধস্তি গ্যাঞ্জাম এখানে নেই; আর ডর্ম টাইপের ক্যাম্পেতো এসিওতো নেই, আছে এয়ারকুলার।

বাতি নিভিয়ে ম্যাট্রেসের ওপর শুতে শুতে জানে আলম টের পেলো ওস্তাদ একটু উসখুস করছে।তার খাটিয়াও মাঝে মাঝে ক্যাচক্যাচ করে উঠছে।একবার ভাবলো একটু উঠে দেখবে নাকি? ওস্তাদের শরীর বেশি ভাল না। অষুদপথ্য নিয়মিত খেলেও ইতিবাচক কোন ফল দেখা যাচ্ছে না।সৈনিকের গড়াইপেটাই করা শরীরে আগের সেই তাকত নেই।খাবারদাবারেও তেমন রুচি নেই।আঙুর আনার খেজুর এসব আনে প্রায়ই, কিন্তু খায়তো জানে আলমই। সে অনেকবারই বলেছে, ‘ওস্তাদ, আচ্ছাসে এলাজ করাও, ঘ্যরমে যাও।‘ ওস্তাদ শুনলেতো।লাহোর সিএমএইচের সার্জনও বলেছিলো, ‘বড়া বড়া ব্লক হায়, বাইপাস করনা পড়েগা।‘ দিলদার খান মাথা নেড়ে চলে এসেছিল হাসপাতাল থেকে, কাটাছেঁড়া সে করাবে না, অষুদে যতদিন চলে চলুক।এজাজ আর আরশাদ বলেছিল, স্ত্রী আর একমাত্র পুত্র আরবাজ খানকে হারানোর পর ওস্তাদ কেমন তারছেঁড়ামতো হয়ে গেছে।ছেলে গেছে ক্রিকেট খেলায় মারামারি করে সহপাঠীর ব্যাটের আঘাতে আর বঊ মরেছে ক্যান্সারে।মেয়ে দুটি যার যার শশুরবাড়িতে।তাই একধরণের শুন্যতায় দিনেদিনে বুকের ভেতর তূষের আগুন আপনাআপনিই তাপ বাড়িয়ে চলেছে।ছেলে মারা যাওয়ার পর সে আর কর্মস্থলে ফিরে আসতে চায় নি।তবে কোম্পানির দেশি ইঞ্জিনিয়ার রাহবার খানের পিড়াপীড়িতে মাসছয়েক পর দুঃখের বোঝা নিয়ে আবার সে স্বপদে ফিরে এসেছে।

আজ একটু বেশি নড়াচড়া করছে দিলদার খান।প্লাস্টিকের বোতল খুলে দু’বার পানি খাওয়ার শব্দও শোনা গেছে।ঘুম আসতে হয়তো দেরি হচ্ছে।

জানে আলমের চোখে তন্দ্রা ভর করতেই গোঙানি আর গলাখাকারি মেশানো এক বিকৃত শব্দ তাকে স্প্রিং-এর পুতুলের মতো ধা করে বিছানায় বসিয়ে দিলো।ত্রস্ত হয়ে বাতি জ্বেলেই সে ওস্তাদকে জড়িয়ে ধরলো, ‘ওস্তাদজি!তবিয়ত আচ্ছা হ্যায় তো?’ দিলদার খান ডানহাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে।শ্বাসপ্রশ্বাসও কেমন ঘ্যাসঘ্যাসে।সে বাঁহাত নেড়ে নেড়ে আশ্বস্ত করতে চাইলো,’কুচ হুয়া নেহি, ঘাবড়াও ম্যত।‘

দিলদার খান বললেই হলো নাকি।কুচ কুচ তো হয়েছেই।জানে আলমের মনটা খারাপ হয়ে যায়।প্রৌঢ় বাব-মার ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।ছ’মাস আগে সে দেশ থেকে ঘুরে এসেছে।জীবনের পথচলায় সময়ের পর্দাটুকু সরালেই দৃশ্যমান হয় পরিবর্তনের চিহ্ন। বাবা-মার চেহারার মানচিত্র বদলেছে অনেক, চুলদাঁড়িতে সাদার প্রলেপ আরো গাঢ় হয়েছে।পাগলপারা হয়ে মেয়ে খুঁজেছেন তারা ছেলের জন্য।কিন্তু পরিকল্পনা আর নিয়তিতো হাত ধরাধরি করে হাঁটেনা।জানে আলমের পিতা শামসুল আলমের হাইহ্যালো বন্ধু পাশের গ্রামের শরাফত আলী মেম্বার জানে আলমের জন্য একটা মেয়ের সন্ধান দিতে তাদের বাড়িতে এসে গোলটা বাঁধালেন।তাদের বাড়িতে ঢোকার মুখেই জানে আলমের ছোটবোন সাফিয়ার সাথে তার চোখাচুখি হয়ে যায়। এর পরের ঘটনাপ্রবাহ খুবই সংক্ষিপ্ত।জানে আলমের বিয়ের আলাপ শিকেয় উঠলো।মেম্বার সাহেব এক বৈঠকেই টেবিল উল্টিয়ে দিয়ে বাজিমাত করে ফেললেন।সিনেমার দ্রুততায় দুই সপ্তাহের মধ্যে শরাফত আলী মেম্বারের দ্বিতীয় পুত্র মোবারক আলীর সাথে শামসুল আলমের কনিষ্ঠা কন্যা শাফিয়া বেগমের শুভ পরিণয় ধুমধামের সাথে হয়ে গেল।এই ঘটনার যৌক্তিক সারমর্ম হলো, জানে আলম ছেলে মানুষ, আগামি বছর তার বিয়ে হলেই চলবে।কিন্তু বন্ধুত্বের সম্পর্ককে আরো আঠালো করতে শরাফত আলীর ছেলের জন্য শামসুল আলমের মেয়েকে চাই ই চাই।ফলতঃ গুরুজন থাকলেও জানে আলমকেই বোনের বিয়ের সার্বিক দায়িত্ব নিতে হলো।জীবনে প্রথমবারের মতো সে দায়িত্ব আর নির্ভরতার ভার অনুভব করলো।সেই থেকে সে না পারছে তার মস্তিষ্ককে তাপমুক্ত করতে আর না সরাতে পারছে মনের মেঘ।যা হবার কথা ছিল প্রথম বিদেশযাত্রার বেলায়,সেই স্মৃতিকাতরতা তাকে পেয়ে বসেছে এখন।জুম করে একেকটা স্লাইড পর্দায় আসছে আর যাচ্ছে – বড়লেখার সবুজ টিলাময় গ্রাম, ছোট্ট ধারার পাহাড়ি ঝর্ণা,ছড়ার স্ফটিকস্বচ্ছ তিরতিরে জল, ডানে-বাঁয়ে-উপরে-নিচে সবুজ আর সবুজের গড়াগড়ি– কোন মহান শিল্পীর হাতে আঁকা নিখুঁত জলছবি।

ওস্তাদ ক্যাঁক করে উঠতেই মরুভূমির শাশ্বত ধুসর রুক্ষ্মতা এক ঝটকায় তার মন থেকে সব সবুজ শুষে নিলো।হকচকিয়ে দিলদার খানের হাত ধরে টান দিলো সে, ‘ওস্তাদ, চলো চলো,হসপিটাল চ্যলো, আবি আবি অ্যাম্বুলেন্স বুলায়গা।‘

‘ঠেরো..।‘, দিলদার খান ট্রাফিক পুলিশের মতো তার বাঁহাত উঁচিয়ে ধরলো।মুখটা যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট।

‘ঠেরাঠেরির সময় নাই, চ্যলো।‘

দিলদার খান এবার মোচড় দিয়ে আধশোয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বিছানায় বসে।জানে আলমকে হাত দিয়ে ঈশারা করে, ‘ব্যয়ঠো।‘

জানে আলম অস্থির হয়ে বলে, ‘আমি সবাইকে ডেকে আনি,হসপিটাল জানা পড়েগা…’

‘আরে, নেহি নেহি, আমি ভাল আছি, ব্যয়ঠো।‘ দিলদার খান মরিয়া হয়ে বাধা দেয় জানে আলমকে।জানে আলম কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো ওস্তাদের পিঠের ওপর হাত রেখে বসে পড়ে।দার আস সালাম অর্থাৎ তাদের ক্যাম্প থেকে সলিমান ফকিহ হাসপাতাল খুব বেশি দূরে নয়। কিন্তু ওস্তাদ গড়িমসি করছে কেন? যন্ত্রণার তীব্রতাও পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছে না। জানে আলম লক্ষ করেছে, ওস্তাদের শরীর বা মন খারাপ হলে তার প্রথম যুগের টু-ইন-ওয়ানে ক্যাসেট ঢুকিয়ে মুহম্মদ রফি, বড়ে গোলাম আলি, মেহেদী হাসান, নূরজাহান, লতা মঙ্গেস্কর এসব শিল্পীদের গান শোনে। কদাচিৎ মিশরের ক্বারী আব্দুল বাসিতের তেলাওতও শোনে কোন কোন সকালে। মাঝে মাঝে অধিকার ফলিয়ে জানে আলমও ওস্তাদের ক্যাসেটপ্লেয়ারে দেশ থেকে নিয়ে আসা হাসন রাজা বা দূরবীন শাহ্‌র গানের ক্যাসেট ঢুকিয়ে দেয়। দিলদার খান সিলেটের কাদামাখা ভাষার গানের মাথামুণ্ডু কিছু না বুঝলেও গানের তালে তালে মাথা ঝাঁকায় আর চোখ ছোট করে মুচকি হাসি হাসে। কিন্তু এ মুহুর্তে তার যে লেজেগোবরে অবস্থা এতে গানটানের প্রশ্নই আসে না।

‘বেটা, তুমহারা ঘ্যর সিলহেট…সিলহেট হ্যায় না? ঠোঁটে কামড় দিয়ে এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে কী যেন খোঁজে দিলদার খান, ‘কিয়া নাম…বিহানিবাজার…বিহানিবাজার…’

‘বিয়ানিবাজার না, বড়লেখা।বিয়ানিবাজার মেরা নানা কা ঘ্যর হ্যায়।‘ জানে আলম শুদ্ধ করে দেয়। কিন্তু সে বুঝতে পারেনা এই জীবনমরণ সমস্যার মধ্যে বিহানিবাজার আর সিলহেটের স্থানটা কোথায়।এমুহুর্তে তার জরুরি প্রয়োজন হলো চিকিৎসা।হার্টের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেতো বিপদ।অধস্তনদের ফাইলপত্র সব দিলদার খানের কাছে থাকে।বসে বসে সবার বাপ-দাদার নাম মুখস্ত করেছে বোধ হয়।এখন তাই সিলহেট আর বিহানিবাজারের কথা মনে পড়েছে।

ওস্তাদ তার ডান হাত দিয়ে বুকের বামদিক খামচে ধরে আছে আর জানে আলমের একটি হাত নিয়েছে তার বাম হাতে মুঠিতে।একটু ঝিমানো ঝিমানো দেখাচ্ছে তাকে এখন।মনে হয় হালকা আরাম বোধ করছে।একসময় সে কাত হয়ে আস্তে আস্তে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।যাক, এখন আর সবাইকে ডেকে হুলুস্থুল না করে রাতটা পার করে দিলেই হয়; সকালবেলা যা করার করা যাবে।একথা ভাবতে না ভাবতেই দিলদার খান ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলো, ‘মেরা বেটা…মেরা বেটা…’ জানে আলম তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে থাকে, ‘রোঁও মাত…রোঁও মাত।‘ আহারে বেচারা! এরকম দুঃসময়েইতো আপনজনের দরকার। তারতো বউ-ছেলে কেউই বেঁচে নেই।

দিলদার খান কি আর থামে।শারীরিক ক্লেশের সাথে স্বজন হারানোর জমাটবাঁধা কষ্ট হয়তো ধীরে ধীরে দ্রবীভূত হচ্ছে। ‘লাড়কা লিয়ে গেলো, বিবি লিয়ে গেল, আবি ম্যায় যাওঙ্গা…’ বলতে বলতে নিজের বুক চেপে ধরে আবার। ‘ইয়ে মেরা গুনাহ্‌ কা নতিজা…আমি জালিম …আমি বেগুনা আদমিকো খুন কিয়া…আওরতকো জিন্দেগি বরবাদ করদিয়া…হামতো ইনসান নেহি…জানোয়ার হোঁ জানোয়ার…ইয়াল্লাহ্‌,আমার কী হবে?’ হেচ্‌কি, গোঙানি, কঁকানির ভেতর দিয়ে সে বলেই চলেছে।

জানে আলমের একটা ঝাঁকুনি লাগে।খুন! আওরাত! ওস্তাদ কি প্রলাপ বলতে শুরু করেছে? জ্বরের ঘোরে মানুষ প্রলাপ বকে বলে জানে সে। কিন্তু ওস্তাদের গায়ে তেমন জ্বর নেই। সে একটু উঁচুগলায় বলে, ‘রুখো ওস্তাদ, আর থামাথামি নেহি চ্যলেগা, চ্যলো, হসপিটাল চ্যলো…।‘ কথা শেষ না হতেই ওস্তাদ খপ করে জানে আলমের হাত দু’টি ধরে বসে। ‘কি? তোম নেহি যাওঙ্গে?’ জানে আলম সত্যি সত্যি ভয় পাচ্ছে।

দিলদার খানের কন্ঠস্বর মাঝেমাঝে নিচু হয়ে যাচ্ছে। ডানেবাঁয়ে মাথা নাড়াতে নাড়াতে স্বগোক্তির মতো আওয়াজ বের করছে মুখ থেকে, ‘বিহানিবাজার…সিলহেট…ইষ্ট পাকিস্তান…।‘ জানে আলম ওস্তাদের মুঠ থেকে তার হাত দু’টি বের করতে চায়, কিন্তু পারেনা। ‘শাহজালাল আউলিয়া…সিলহেট’, এখন ফুঁফিয়ে কেঁদে ওঠে সে, ‘তুমি জানোনা বেটা…আমি ক্রিমিনাল সিপাহী হ্যায়…সেভেনটিওয়ান…আমি বহত বুরা কাম কিয়া তুমহারা মুল্লুকমে…আল্লাহ্‌ আমাকে সাজা দিল…বেটা লিলো, বিবি লিলো…কিতনি মাসুম লাড়কিঁউকি জিন্দেগি…আমি জালিম…আমি জানোয়ার…’, দিলদার খানের অস্থিরতা বাড়ছে আর গলার স্বরও উঠানামা করছে।

লাড়কি! একটু আগেও বললো, খুন, আওরাত! কী বলছে ওস্তাদএসব! তবে কি…হঠাৎ করে জানে আলম মূঢ়তা আর মোহগ্রস্থতার পর্দা ছিঁড়ে এক উন্মুক্ত দিগন্তের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো – যেন বিয়ানিবাজার বড়লেখার গা-ঘেষা কুলকিনারাহীন হাকালুকি হাওর। তার মাথা টনটন করছে, হৃৎপিণ্ডের বিট্‌ শোনা যাচ্ছে । নিজের ভেতরের দয়ার্দ্র মানবকে সে খুঁজে পাচ্ছে না আর। এখন সে নিশ্চিত, দিলদার খান কোন প্রলাপ বকছে না! যা বলছে সব সত্য, কনফেশন, পাপের স্বীকারোক্তি। সিলহেট, বিহানিবাজার, সেভেনটিওয়ান এসব কথা জানে আলমকে শুনিয়ে কি সে দায়মুক্তি নিচ্ছে? জানে আলমতো সেভেনটিওয়ান দেখেনি। আর বড়দের কাছ থেকে যা শুনেছে তা অনেকটা ইতিহাস বইয়ের পাঠ মনে হয়েছে তার কাছে। কিন্তু দিলদার খানতো পুঁতিগন্ধময় জীবন্ত ইতিহাস, হায়েনাসঙ্কুল সেভেনটিওয়ান। এই তিনবছর সে কেমন করে এই আস্তাকুঁড়ে ছিল? এখন তার চোখজুড়ে আদিগন্তবিস্তৃত হাকালুকির কুয়াশাচ্ছন্ন পর্দা; কোন সবুজ নেই, কোন পাহাড় নেই, কোন ঝর্ণা নেই। পর্দার গায়ে ছোপছোপ লালরঙা শাড়ির অগুনতি আঁচল সিনেমার ফ্লাশব্যাকের মতো সাঁ করে আসছে আর যাচ্ছে। আঁচলের ফাঁক দিয়ে মেঘমাখা নারীমুখ একবার ভাসছে একবার ডুবছে। অসংখ্য মুখ। জানে আলম দূরবীণের তীক্ষ্মতা নিয়ে বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে দেখে অই মুখের ছবিটা তার মায়ের মতো। সে শিউরে ওঠে। মনযোগ দিয়ে পরের ছবিটা দেখার চেষ্টা করে সে। একি! এটাওতো তার মায়ের ছবি। পরের ছবিটাও। পরেরটাও… সবগুলি ছবিইতো তার মায়ের…।

জানে আলম মাথাঘুরে খাটিয়া থেকে পড়েই যেতো যদি না দিলদার খান হেঁচকা টানে তার হাতদু’টি নিজের দিকে টেনে নিতো। সে এবার ঘৃণার সাথে তার হাত দু’টি ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু দিলদার খান প্রাণপণে আর্তনাদ করে ‘মার ঢালো, মুঝে মার ঢালো, ম্যয় গুনাহ্‌গার হোঁ’ বলতে বলতে জানে আলমের দু’হাত গায়ের শেষ শক্তি দিয়ে নিজের গলায় দাবিয়ে দিলো।

জানে আলম বুঝতেই পারলোনা দিলদার খানের দেহখানি আপনাআপনি নিথর হয়ে গেলো নাকি তাকে দাবড়াতে আসা সেভেনটিওয়ানের আত্মাগুলো জানে আলমের দু’হাতের ওপর চেপে বসেছিল।

জামাল উদ্দিন আহমদ