রম্য গল্প

বিসিএস ক্যাডার

সোহাইল রহমান:

জামান ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে বিসিএস দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে। আজ তার প্রথম কর্মদিবস। অফিসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় জামানের বাবা আখলাক উদ্দিন ছেলেকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘আজ আমি খুব খুশি৷ তুমি একজন বিসিএস ক্যাডার হিসাবে গড়ে উঠতে পেরেছো। এখন এতোদিন কষ্ট করে যত লেখাপড়া করেছ সেগুলো বাকি জীবন প্রাকটিক্যালি প্রয়োগ করার সময় এসেছে। এতোদিনের শিক্ষাটুকু সারাজীবন মনে রাখলেই তুমি জীবনের সব পর্যায়ে সফল হবা। তোমার জন্য আমার পক্ষ থেকে শুভকামনা।’

জামানের চোখে জল চলে আসলো। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারা খুশির জল। আখলাক সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে জামান প্রতিজ্ঞা করলো। বললো, ‘তোমার কথামতো আমি আমার এতোদিনের শিক্ষা কর্মক্ষেত্রে ঠিকভাবে প্রয়োগ করবো। কথা দিলাম।’

অফিসের তৃতীয় দিনেই সে সুযোগ আসলো। ভ্রাম্যমাণ আদালত হিসাবে একটা গ্রামে গেলো জামান। কলেজের এক ছেলে তার জুনিয়র মেয়েকে রাস্তায় টিজ করেছে। কিন্তু ছেলে স্বীকার করবে না। তার একই কথা, ‘আমি কিছু করিনি। মেয়ে আমার সাথে প্রেম করতে চেয়েছিলো, আমি রাজি হইনি বলে আমাকে ফাসাচ্ছে।’

বেশ ঝামেলায় পড়লো জামান। এখন কি করবে? মাথায় হঠ্যাৎই বাবার উপদেশ ভেসে উঠলো। এতোদিনের শিক্ষা কাজে লাগাও। বড় একটা শ্বাস ছেড়ে জামান ছেলেটাকে প্রশ্ন করলো, ‘জিএইট ভুক্ত দেশগুলোর নাম কি?’

ছেলেটা অবাক হয়ে চেয়ে আছে। জামান আবার প্রশ্ন করলো, ‘বলো ন্যাটোর সদর দপ্তর কোথায় অবস্থিত?’

ছেলেটা উত্তর দিতে পারলো না। জামান ঘোষণা করলো, ‘এই ছেলেই নিশ্চিত ইভ টিজিং করেছে।’

ভ্রাম্যমান আদালত ছেলেটাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিলো, সাথে ত্রিশ হাজার টাকা জরিমানা।

এভাবে আরো কিছু কেস সলভ করার পর জামান রিয়েলাইজ করলো, বিসিএসের পড়ালেখা রিয়েল লাইফে আসলেই অনেক কাজে দেয়। মানুষ শুধু শুধুই এটা নিয়ে ট্রল করে৷ যারা ট্রল করে তারা কোনোদিন বিসিএস পাশ করতে পারেনা বলেই ট্রল করে।

এই লেখাপড়া যে রিয়েল লাইফে আসলেই কাজ করে জামান পুরোপুরি নিশ্চিত হলো আরো কিছুদিন পর। নাতাশা নামের এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়েছে সে। কিন্তু বুঝে উঠছে না কিভাবে প্রপোজ করবে। কর্মক্ষেত্রে জাদরেল ম্যাজিস্ট্রেট হলেও প্রেমের রাস্তায় সে নিতান্তই বাচ্চা। শেষমেশ অনেক সাহস সঞ্চয় করে একদিন নাতাশার সামনে গিয়ে দাড়ালো জামান। বললো আমার কিছু কথা আছে।

নাতাশা মুচকি হাসলো, ‘কি কথা? বলেন।’

জামান কোনোমতে চোখমুখ শক্ত করে বললো, ‘পল্লীকবি জসিম উদ্দিনের কবর কবিতায় ‘কবর’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এগারো বার। আর সোনার তরী কবিতায় ‘সোনার ধান’ কথাটা ব্যবহার হয়েছে দুইবার।’

নাতাশা অনেক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর জামানের হাত ধরে বললো, ‘আমি বিয়েতে রাজি।’

বিয়ের পর জীবনটা ভীষণ আনন্দে কাটতে লাগলো জামানের। হানিমুনে গেল থাইল্যান্ড। প্রথমবার বিমানে উঠে সিস্টেম দেখে সে তো পুরোপুরি অবাক। পাইলটের কাজ হলো প্রথমে শরৎচন্দ্রের সবগুলো উপন্যাসের নাম মুখস্ত বলা। এতেই বিমান রানওয়ে দিয়ে চলতে শুরু করে। তারপর মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ছোটগল্পগুলোর নাম বললেই বিমান উড়তে শুরু করে। এমনকি জামান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অক্ষশক্তির দেশগুলোর নাম জানে বলে তার সিটবেল্টও পরা লাগেনাই।

জীবন যেন জামানের জন্য আরো অবাক হওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। দেশে ফিরে বাড়ি করার জন্য ব্যাংক থেকে লোন নিতে গিয়ে দেখে পুরো ব্যাংকিং সিস্টেমটাই দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের বড় দশটা জলপ্রপাত আর মরুভূমির নামের ওপর। সবগুলো মুখস্ত বলতে পারায় একপ্রকার বিনা সুদে লোন পেয়ে গেলো জামান। বাড়ির কাজ শুরু করতে গিয়ে অবাক হলো আরো। সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা পুরো বাড়ির ডিজাইন করছে শুধুমাত্র কিছু ইংরেজি সিনোনিম আর এন্টোনিমের ওপর ভিত্তি করে। জামানের ইঞ্জিনিয়ারের ভোকাবুলারি ভালো ছিলো বিধায় তার বাড়িটাও হলো বেশ সুন্দর আর মজবুত।

এদিকে নাতাশা প্রেগনেন্ট৷ দশ মাস পর এক রাতে নাতাশার ব্যাথা উঠলো৷ দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার চিন্তিত গলায় বললো, ‘বড় একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। মা আর বাচ্চাকে একসাথে বাঁচানোর একটাই মাত্র উপায় আছে।’

জামান উৎকণ্ঠিত গলায় জানতে চাইলো, ‘কি সে উপায় ডাক্তার সাহেব?’

ডাক্তার অনেক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘সে উপায়টা হলো মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো দেশের রাজধানী ও মুদ্রার নাম জানতে হবে। একটা ভুল হলেই শেষ।’

জামান ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপনিও বিসিএস ক্যাডার?’

ডাক্তার হ্যা সূচক মাথা নাড়লো, ‘আমিও ক্যাডার।’

জামানের ভাগ্য ভালো ছিলো৷ এই ডাক্তার বেশ মেধাবী। কিচ্ছু ভোলেনাই। ইরাক সিরিয়া হয়ে কাতারের রাজধানী আর মুদ্রার নাম বলতে না বলতেই বাচ্চা ডেলিভারি হয়ে গেল। ডাক্তার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘মা আর বাচ্চা দুজনেই সুস্থ আছে।’

পরিশিষ্ট: জামানের বয়স চুরাশি বছর। মৃত্যুশয্যায় শায়িত। সফল একটা জীবন কাটিয়ে এখন তার শেষ সময় উপস্থিত। ছেলে মেয়ে নাতিপুতিরা সবাই তাকে ঘিরে বসে আছে। জামান সবার দিকে একবার তাকিয়ে বললো, ‘আজ আমি তোমাদের একটা কথা বলে যেতে চাই মরার আগে। জীবনে যা কিছুই হোক না কেন, যত বিপদই আসুক না কেন, সবসময় এই কথাটা মনে রাখবা। তাহলে কোনো সমস্যাই আর সমস্যা থাকবে না।’

‘কি সেই কথা বাবা?’ – ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলো জামানের বড় ছেলে।

জামান অল্প একটু হেসে বললো, ‘কথাটা হলো উগান্ডার প্রেসিডেন্টের নাম ইয়োবেরি মুসেভেনি।’ বলেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো জামান। তার চোখেমুখে তখনো অন্যরকম এক তৃপ্তির ছোঁয়া!