রঙের জীবন

রামধনু || তরুণ প্রামানিক

কাল রাতে কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া এলোমেলো চিন্তারা ভিড় করেছিল কাবেরীর মাথাতে।এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে রাত ভোর হয়ে গেছে তা নিজেই বুঝতে পারেনি।ভোরের নরম আলো চোখের পাতা ছুঁতেই বিছানা থেকে লাফিয়ে ওঠে সে।৫.৩০ টার অ্যালার্ম বাজতে এখনো ঢের দেরি।ঘড়ির থেকে চোখ সরিয়ে মেয়ে তৌশিনীর দিকে তাকায় কাবেরী।ফুল হয়ে ফোটার আগে কুঁড়ি যেমন এক অনিবর্চনীয় আভিজাত্য নিয়ে হাওয়ায় দোলে,ছোট্ট তৌশিনীও নরম বিছানার আদরে ঘুমন্ত শরীর টাকে এলিয়ে রেখেছে ঠিক তেমন করে। মেয়ের মুখের উপর পরে থাকা এলো চুলগুলো কে সস্নেহে দুহাত দিয়ে সরাতে থাকে কাবেরী। 

–মাম্মা উঠে পর স্কুল এ যেতে হবে না!আজ তো তোমার রেজাল্ট, মনে আছে?
এপ্রিল এর এই চড়া গরমের সকালটা তে কেমন যেন ঘুমোট হয়ে আছে চারিদিকে।বাচ্ছাদের পরীক্ষা গুলো কেন যে তাড়াতাড়ি হয়ে যায়না এই ভেবে মনে মনে রাগ হতে থাকে কাবেরীর।বাংলা মিডিয়াম স্কুল গুলোর তো সেই কবেই সামার ভ্যাকেশন শুরুও হয়ে গেছে কিন্তু এদের?না!সে সবের এখনো অনেক দেরি।আজ সবে আপার নার্সরীর রেজাল্ট!তারপ নতুন ক্লাসের এডমিশন, বইকেনা,শেষে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন করে মে মাসের মাঝামাঝি তে সামার ভ্যাকেশন।মোবাইল ফোনের রিংটোনের আওয়াজে সম্বিৎ ফেরে কাবেরীর।হাত খোঁপা করতে করতে বিছানার উপরে থাকা মোবাইলের স্ক্রিন এর দিকে তাকিয়ে প্রায় খানিকটা অবাকই হয়ে যায় সে।ফোনটা সঞ্চিতার।সঞ্চিতার মেয়ে ঐশী আর তৌশিনী একই সাথে একই ক্লাস এ পড়ে।বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে মাত্র ঘন্টা কয়েকের জন্যে ওরা আর বাড়ি ফিরতো না কেউ। নিজেরা দোকান থেকে কিনে সামান্য জলখাবার খেয়েই গল্পে আর আড্ডায় সময়টা কাটিয়ে দিতো গাছের ছায়ায় বসে বা এ দোকান ও দোকান ঘুরে। আপার নার্সারির শুরু থেকে সঞ্চিতা আস্তে আস্তে নানা অছিলায় ওদের সাথে আর আড্ডায় বসছে না। বাড়ি ফিরে যাচ্ছে প্রতিদিনই।একদিন গম্ভীর মুখে জানালো, শাশুড়ির নাকি পছন্দ নয়। ঘরে অনেক কাজ থাকে সক্কালবেলায়।তাই ফিরে যেতে হয় ওকে।কাবেরী আর সঞ্চিতার বন্ধুত্বটা একটু বেশি ছিলো।কিন্তু কাবেরীও ঠিক জানে না আসল রহস্যটা কোথায়? ওর কথার ধরণেই বোঝা যায় কিছু একটা লুকোচ্ছে।নতুন কোন পুরুষের আগমন ঘটেনি তো? বেশ একটা চটক আছে সঞ্চিতার চেহারায়!!

একদিন সঞ্চিতা বাড়ির পথ ধরতেই কাবেরী আর মিলি ওর পিছু নিলো। স্কুলের পেছন দিকের গলিতে ঢুকে গেল সঞ্চিতা। ওরা দেখলো দারোয়ান স্কুলের পিছনের দরজাটা খুলে দিলো আর সঞ্চিতা ভেতরে ঢুকে গেলো। ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারলো না। ঠিক করলো পরের দিন সঞ্চিতা চেনে না এরকম কোনো একজনকে পেছনের গেটে নজর রাখার জন্যে ঠিক করবে। পেয়েও গেলো রুমিকে।রুমির ছেলে এবছর নতুন ঢুকেছে স্কুলে, বিশেষ কেউ চেনে না।মিলির পাড়ায় থাকে রুমিরা।দিন কয়েক পর রুমি এসে জানিয়েছিল আসল ঘটনা টা ঠিক কি। আস্তে আস্তে মরচে পরতে থাকে তাদের এত দিনের সুন্দর সম্পর্কের।সপ্তাহের শেষে সবাই মিলে হৈ হৈ করে খেতে যাওয়া ,শীতের দুপুরে ভিক্টোরিয়া,চিড়িয়াখানা,ইকোপার্ক।নাঃ!!!আজ সঞ্চিতা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে সব থেকে!আর ছোট্ট ঐশী কে করেছে পড়াশোনার যাঁতাকলে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দি!কাবেরী রুমির থেকে এও জেনেছে যে ,শধু তাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে ক্লাস রুম এর সামনে গিয়ে নোটস নেওয়াই নয় দুজন ক্লাস টিচার এর বাড়িতে গিয়ে মোটা টাকা দিয়ে স্পেশাল নোটস নিচ্ছে সে।যে করেই হোক ফার্স্ট,সেকেন্ড,বা থার্ড একটা পসিশন এ স্ট্যান্ড করাতেই হবে। এতটাই আদাজল খেয়ে নেমেছে সঞ্চিতা যে গান্ডীব ভাঙার লক্ষ্যে সে নিজের মেয়ের শৈশব কেই দিচ্ছে বলি। ওদের পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রায় অনেক দিনই হলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ নেই কাবেরী আর সঞ্চিতার মধ্যে। বলাভালো যে সঞ্চিতাই কোনো যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে নি। আজ হঠাৎ ওর ফোন পেয়ে একটু ঘোর লেগে গেল কাবেরীর। 
–হুমম বল
–কখন আসছিস?আমারতো আর তর সইছে না !!! কখন যে ৮.৩০ টা বাজবে,রেজাল্ট টা শোনার জন্য আমি অস্থির হয়ে রয়েছি।ঐশী এবার স্ট্যান্ড করছেই করছে।আমার তরফ থেকে তোদের জন্য একটা ট্রিট বাধা। 
–ঐশী সোনা ভালো মেয়ে,ও নিশ্চই খুব ভালো রেজাল্ট করবে। কিন্তু এখনই ওর রেজাল্ট এর ব্যাপারে এত মাথা ঘামানোর কি আছে !!! 

–কি বলছিস?মাথা ঘামাবো না!!! ওর পাপাই তো বলেছে এখন থেকে মেয়ে যদি স্ট্যান্ড করতে না পারে তবে আর কোনোদিনই প্রতিযোগিতায় থাকতে পারবে না,তাই এখন শুধু আমাদের কাজ ওকে প্রেসার দিয়ে এই এডুকেশন সিস্টেমে ঢুকিয়ে দেওয়া তারপর আপনা আপনিই ই ই 
–ও তাই বুঝি ওকে সিস্টেমে ঢোকাতে শাশুড়ির দোহাই দিয়ে আমাদের লুকিয়ে মেয়ের সাথে সাথে এতদিন ক্লাস থেকে ডাবল নোটস নিচ্ছিলি ?আর ওই স্পেশাল নোটস সেটা? কি দরকার এখনই ওদের ব্যাপারে এত সিরিয়াস হওয়ার।
পথ চলতে গিয়ে হঠাৎ পায়ের কাছে সাপ পরলে মানুষ যেমন লাফিয়ে ওঠে,কাবেরীর কথা শুনে সঞ্চিতা ঠিক তেমনি চমকে উঠলো। কথা শেষ করে ফোন রাখতে রাখতে কাবেরীর একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস মিশে গেল সকালের তপ্ত বাতাসে। 
কাবেরীর মেয়েকে নিয়ে স্কুলে পৌঁছাতে একটু দেরিই হলো।সকালথেকেই একটা গুমোট কেমন যেন থম মেরে রয়েছে চারিদিকে।কাবেরী দেখলো স্কুলের গেটের বাইরে সান বাঁধানো আমলকি গাছের গোড়ায় সঞ্চিতা আর মিলি অপেক্ষা করছে তার জন্য,সঞ্চিতার হাতে বড় একটা মিষ্টি বা ওই ধরণের কিছুর একটা প্যাকেট। মিলির ছেলে অরিত্র পিঠে স্কুল ব্যাগ আর গলাতে একটা গোলাপি ওয়াটার বোতল ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তৌশিনী ঐশী কে দেখে দৌড়ে গেল ওর কাছে। কত্ত দিনের চেনা জায়গা আজ কিন্তু একটু অচেনা লাগছে কাবেরীর কাছে।মিলি কাবীরে কে দেখে এগিয়ে এলো 
–চলো কাবেরী দি,আমরা তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম এতক্ষন। 
আজ একমাত্র ওই রেজাল্ট এর জন্যই সবার স্কুলের ভিতরে যাওয়ার অনুমুতি মেলে। কাবেরী লক্ষ্য করলো যে সে স্কুলে আসা পর্যন্ত সঞ্চিতা তারজন্য একটি কথাও খরচ করে নি।কেমন যেন একটা অজানা উদ্বেগ এর মধ্যে রয়েছে সে।মার্কশীট দিতে দিতে তা প্রায় দশ টার ও বেশি বেজে গেল। অভিভাবকদের ক্ষোভ বিক্ষোভ, হা হুতাশ ,ছাত্রছাত্রীদের দস্যিপনা আর হৈ চৈ কে পাশ কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো ওরা তিনজন বাচ্ছাদের দেড় সাথে নিয়ে।স্কুলের ভিতর থেকে এতক্ষন কিছু বোঝা যাচ্ছিলো না,বাইরে বেরিয়ে এসেই দেখলো সকালের চড়া রোদ টা উধাও

মিশমিশে ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে আকাশটা ।এই সময় টাকে সন্ধ্যার আগের মুহূর্ত বলে ভ্রম হতে পারে অনেকেরই। সাত পাঁচ না ভেবে জোড়ে পা চালালো ওরা। সহসা এক রাশ ধুলো ঝড় হয়ে চোখ মুখ ঢেকে দিলো সকলের। মুহূর্তের মধ্যে কোথা থেকে উঠলো প্রবল দমকা হওয়া।ঝিরি ঝিরি পাতার আমলকির মোটা ডাল ভেঙে আছাড় খেয়ে পরলো ওদের সামনেই। ছিটিয়ে থাকা প্লাস্টিকের ঠোঙাগুলো ফসকে যাওয়া গ্যাস বেলুনের মতো এদিকে ওদিকে উরে গেল।কালো আকাশের বুকচিড়ে অজস্র শিকড়ের মতো চোখ ঝলসানো বিদ্যুৎ রেখা ঝলসে উঠলো বারবার এদিকে ওদিকে।প্রবল মেঘের গর্জনে রাঙামাসীর চায়ের দোকানের টিনের চালাটা কেঁপে উঠলো। কাবেরী মেয়ে কে কোলেতুলে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে ঢুকলো রাঙামাসীর দোকানে।ওদের দেখাদেখি সঞ্চিতা ,মিলি রুমাল দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে চলেএলো কাবেরীর পিছুপিছু, রাঙামাসী তার দোকানের সামনের দিকের পাল্লাটা আটকে দিলো অধের্কটা। বাইরে শুরু হলো ঝড়ের তান্ডব।দূরে কোথায় যেন পরপর বাজ পড়ল।প্রচন্ড হওয়ার দাপটে রাঙামাসীর দোকানটা কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। ভগবান চাইলে হয়তো আজ সবসুদ্ধু ভেঙে পড়বে মাথার উপর।

কাবেরী আবছা অন্ধকারের মধ্যে দেখলো সঞ্চিতাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে মেয়ে ঐশী।ভয়ে ওর ঠোঁট দুটো যেন কাঁপছে। ছোট্টো অরিত্র দুহাত দিয়ে দুচোখ ডলেযাচ্ছে ক্রমাগত। মিলি বাইরের দিকে মুখ বাড়িয়ে জানালযে ঝড়ের দাপট সামান্য কমলেও অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাঙামাসীর টিনেরচাল প্রমানদিলো সেকথার। ঝড় আর সাথে তার দোসর বৃষ্টি। অর্ধেকটা খোলা জায়গা দিয়ে বৃষ্টির একটা ঝাপটা এসেপড়লো ওদের মুখের উপর,চোখেরউপর, বুকেরউপর। স্কুল গ্রাউন্ডটা কে বৃষ্টিতে সাদা কুয়াশার চাদরে মোড়ানো অস্পষ্ট কোনো অপার্থিব মায়াময় স্থান বলে মনে হচ্ছে। রাঙামাসী এই সাতসকালে দোকানের আলোজ্বালাতে গিয়ে দেখলো কারেন্ট অফ। আর হঠাৎ এই কালবৈশাখীর তান্ডবে কারেন্ট থাকবেইবা কেমন করে !!! মাসী অনেকখুঁজে একটা গামলা উপুর করে ওর উপরে অর্ধেকপোড়া একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলো,মোমবাতির শিখাটা বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। কাবেরীই নিরাবতা ভাঙলো প্রথমে
–সঞ্চিতা কি হল তোর? চুপ কেন? 
একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সঞ্চিতা,তিরতির করে ওঠা মোমবাতির শিখাটা একটু নড়ে গেল। রাগ আর অভিমান মিশ্রিত গলায় ঝাজিয়ে উঠে বললো 
–না রে কিছু হবে না আমার মেয়ের দারায়।অন্যেরা ফার্স্ট হবে,মেডেল পাবে আর ও বসেবসে শুধু হাততালি দেবে। অপদার্থ একটা। 
–কেন ৬০% এ তুই খুশি নোস্?
–কী করে খুশি হই বলতো? আমি আর ওর পাপাই তো ধরেই নিয়েছিলাম আগেরবার হয়নি কিন্তু এবার মেয়ে স্ট্যান্ড করছে! আর মেয়ে করলো কি!!! সব হিসাব এলোমেলো করেদিল। সবাই কে মুখ দেখাবো কি করে! ছিঃ ছিঃ!!!
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলেগেল সঞ্চিতা। মিলি এতক্ষন চুপকরে শুনছিলো ওদের কথা। সে গলা চড়িয়ে বললো 
–আচ্ছা কাবেরীদি তোমার মেয়েতো ৯৯% পেয়ে প্রথম হল,তুমিও কী সঞ্চিতারমতো খুশি নও ? নাকি তুমিও ১০০% ই আশা করেছিলে?
–না একদম ই নয়। আমার মেয়ে ফার্স্ট হয়েছে আর সঞ্চিতার মেয়ে এক থেকে দশ এর মধ্যেই আসতেপারেনি বলে এমনটা বলছি না আসলে আমারকাছে ৬০% বা ৯৯% এগুলো এক একটা সংখ্যা ছাড়া আর অন্য কিছু নয়। মেধার মূল্যায়ন আমি সংখ্যায় করিনা। আমার মেয়ে যতটুকু যা পেয়েছে তা সে নিজের খেয়ালেই পেয়েছে। অহেতুক চাপ দেওয়ার পক্ষপাতী আমি নই ভাই।
মিলি কিছুএকটা বলতে যাচ্ছিল ওকে থামিয়ে দিয়ে সঞ্চিতার মেয়ে ঐশী কে কাছে টেনেনিল কাবেরী। মাথায় হাত দিয়ে আদরকরতে করতে বললো 
–এই ছোট্ট বয়সে ওরা শিখবে প্রানভরে,অনেক অনেক জানার আগ্রহ ওদের পাগল করে তুলবে। নিজে থেকে ওদের ডালপালা মেলার সুযোগ করেদিতে হবে আমাদের তাই না !!! আর তা না করে যদি আমরা এখনই ওদের প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলেদিই আর তাতে যদি অসফল হয়,তাহলে ওদেরমনে ভয় জন্মেযাবে, যে ভয় গিলে খাবে ওদের সারাজীবন।কাবেরীর কথা টা বেশ মনে ধরলো মিলির। তার ছেলেও প্রায় ৬৫% মার্কস পেয়েছে। কম বা বেশি এই নিয়ে সে এতো বিচলিত নয় সঞ্চিতার মতো। কিন্তু সব যুক্তি আজ অর্থহীন সঞ্চিতার কাছে। গাদা গাদা টাকা খরচ করে লুকিয়ে লুকিয়ে নোটস নিয়ে সেই নোটস মেয়ে কে পাখি পড়ানোর মতো মুখস্থ করানো যে কোনো কাজেই দিলো না।সে যে একদমই খুশি নয় ওর মুখের অভিব্যাক্তি আর উদাসীনতায় সেটা একদমই স্পষ্ট। ওর এই একরত্তি মেয়েটার গানের গলা আর আঁকার হাত দেখলে অনেকেরই হিংসা হতে বাধ্য।কিন্তু একমাত্র সঞ্চিতার কাছেই সেটা নিতান্তই তুচ্ছ আর মূল্যহীন। দুহাত ভরানো গাদাগুচ্ছের নম্বর এর পাহাড় একমাত্র চিহিদা এদের তা সে যেভাবেই হোক। এমন অবুঝ সন্তানের মাকে আজ বোঝানোর মতো কোনো ভাষা খুঁজেপাচ্ছে না কাবেরী। ওরা দুজনে খুব ভালো বন্ধু হলেও সঞ্চিতা যে কাবেরীর মেয়ের অসাধারণ প্রতিভার জন্য ওদের সাথে কোনোদিনই এঁটে উঠতে না পেরে মনে মনে হিংসা করতো এটা কাবেরী বিলক্ষণ বুঝতো কিন্তু বিষয়টাকে বরাবরই হালকা করে দেখে এক ফুঁত্কারে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ কোন যেন সঞ্চিতার বিমর্ষতা দেখে ওর খুব মায়া হলো। রাঙামাসীর মোমবাতিটা প্রায় নিভুনিভু হয়েএসেছে। কাবেরী নিজের ব্যাগের থেকে একটা জলের বোতল বারকরে তারথেকে একঢোক জলখেয়ে সঞ্চিতার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললো 
–আমার জীবনের একটা অজানা গল্প বলি। 
রাঙামাসীর টিনের ছাদের উপর মুষলধারে বৃষ্টি আছড়ে পড়তে থাকে।পৃথিবীর এতদিনের তেষ্টা যেন একদিনে মেটাবে,বৃষ্টি যেন সে প্রতিজ্ঞাই করে নেমেছে আজ।চারিদিক চাপ বেঁধে আছে জমাট বাধা নিকষ অন্ধকার না বলা কোনো গোপন কথার মতো।কাবেরী আরম্ভ করে তখন সে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারএ পড়ে।তার ভাই তারথেকে প্রায় অনেকেই ছোট। কাবেরী মেয়ে হয়ে জন্মানোয় তার প্রতি প্রত্যাশা বিশেষ ছিলনা পরিবারের। দুদিন পরে অন্যের হেঁশেল ঠেলবে এটাই ছিল তার ভবিতব্য। তাই পরিবারের সন্মান রক্ষার দায়িত্ব গিয়ে বর্তায় শিবরাতির সলতে তার একমাত্র ভাই এর উপর। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ছিল সে।তবুও একটু বড় হতেই লেখাপড়ার প্রবল চাপ চাপিয়ে দেওয়া হলো তার কাঁধে।অন্যথায় বাবার বুককাঁপানো ধমক।দিদির কোলে মাথা রেখে আকাশের মিটমিট করা তারাদের দিকে তাকিয়ে বলতো সে একদিন মস্তবড় ডাক্তার হবে।ভাইয়ের প্রতি গর্ব আর অহংকারে কাবেরীর চোখ ভিজে আসতো।ভাই তখন ক্লাস নাইনএ পড়ে,সামনেই মাধ্যমিক পড়াশোনার ভীষণ চাপ।বাবার বেঁধে দেওয়া রুটিন মেনে টার্গেট কে পাখির চোখ করে এগোতে থাকে।নাওয়া খাওয়া ভুলে সে সারাদিন পড়ার ঘরে বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকে অকুল সাগরের মাঝে একা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের দ্মতো।যে করেই হোক পরিবারের সক্কল কে খুশি করার দায় যে তারই ঘারে।এক এক করে অংক,ভূগোল,বিজ্ঞান সব পরীক্ষাগুলো শেষ হয়েগেলো।ওর বন্ধুরা কেউ মামারবাড়ি,কেউবা সমুদ্র বা পাহাড়ে গেল কিন্তু ভাইয়ের ছুটি মঞ্জুর হলনা। বাবার অনুশাসন আর ধমকে পরের বছরের পাঠে ব্যাস্ত করলো নিজেকে। 
কাবেরী কত চেষ্টা করেছে দিনটাকে ভুলতে কিন্তু আজ পারেনি। রেজাল্টের আগেরদিন সন্ধ্যার পরথেকে ভাইকে ওর পড়ার ঘরে না দেখে বাবা ওকে এদিক ওদিক ওর খোঁজ করে।রাত বারতে থাকে,তখনও পর্যন্ত ও না ফেরায় রক্তচাপ বাড়তেথাকে সবার।মা মূর্ছা যায় বারবার।বাবা লোক পাঠায় চারিদিকে।রাত ভোর হয়ে আসে কিন্তু কেও কোনো সন্ধান দিতেপারলো না তখনও।সারা রাত দুচোখের পাতা আর এক করতে পারেনি সেদিন কেউ।সকাল হতেই দেবশিশুর মতো নিষ্পাপ ভাইটা ফেরে বাড়িতে,কিন্তু জীবন্ত নয়।নিথর দুমড়ানো,মুচড়ানো,বিকৃ­ত মৃত অবস্থায়। কাবেরী তার পড়ার ঘর থেকে খুজেপেয়েছিলো দু লাইনের একটা সুইসাইড নোট। আজো এই পোড়াচোখে ভেসে আছে লেখাটা “আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়,আমি স্বেচ্ছায় কুইট করলাম।” ভাই একরাশ অভিমান বুকেনিয়ে চিরজীবনের মত অন্তহীন ছুটিতে চলেগেলো সবাইকে ফেলেরেখে। 
কথা শেষ করে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো কাবেরী।চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো ক্রমে শেষের কথাগুলো বলতেবলতে গলা যেন ধরেআসছিলো তার।সঞ্চিতা কাবেরীর কাঁধে হাতরেখে মুখ নিচু করে থাকে।বুকের ঠিক মাঝখান থেকে জমাটবাঁধা একটা চাপা কষ্ট পেচিয়ে উপরের দিকে উঠে বাস্প হয়ে দুচোখ ভিজিয়ে দিলো সঞ্চিতার।মিলিরও দষ্টি আবছা হয়েআসে, সে ইশারায় দেখায় আবছা মেঘের আড়াল থেকে সূর্যের নরম আলো ঠিকরে পড়ছে মাটিতে,আকাশে তখন রামধনুর সাত রং।তার নিচে রাঙামাসীর দোকানের সামনে জমেথাকা জলে কাগজের নৌকো ভাসতে ব্যস্ত তাদের ভবিষৎ প্রজন্ম।