কবিতা

সাত মার্চের ভাষণ || শফিকুল ইসলাম শফিক

(বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাত মার্চের ভাষণ অবলম্বনে…)

দুঃখ ভারাক্রান্ত আমি এই কথাটি মানো
সবার সামনে হাজির হলাম সবই বোঝ জানো।
জীবন দিয়ে লড়াই করি মাতৃভূমির তরে
তবু দেখি রক্তে ভেজা পথও কেমন করে?
দেশের মানুষ চায় অধিকার সবাই বাঁচতে চায় চায় না কোনো হানাহানি মুক্তি যেন পায়।

কী অপরাধ করেছিলাম জানার ইচ্ছে করে?
শাসনতন্ত্র হয়নি গঠন নির্বাচনের পরে।
ইচ্ছে ছিল গড়ব এ দেশ শঙ্কা কেটে যাবে
থাকবে নাকো বাড়াবাড়ি মুক্তি মানুষ পাবে।
তেইশ বছরের শোনো ভাই করুণ ইতিহাস!
অত্যাচারে-রক্তপাতে ভারী চারিপাশ।
মুমূর্ষ নর-নারীর বুকে আর্তনাদের ধ্বনি
দুখের কথা দুখের সঙ্গে বলি দিন রজনী।

রক্ত দিয়ে আমরা লিখি ইতিহাসের খাতা
অশ্রু সেও যায় গড়িয়ে ভিজে প্রতি পাতা।
বায়ন্নতে রক্ত দিলাম সঙ্গে চোখের জল
চুয়ান্নরই নির্বাচনে আমরা জয়ী দল।
আমরা তবু পাইনি গদি নীতি কেঁদে মরে
আইয়ুব খানের ষড়যন্ত্র রাখলো গোলাম করে।
ছেষট্টিতে ছয়টি দফা প্রাণের দাবি যত? আন্দোলনে গুলি করে মারল ছেলে কত!

ঊনসত্তুরে আন্দোলন পতন আইয়ুব খানের
সরকার নিলেন ইয়াহিয়া কোন্ সে জয়গানের?
শাসনতন্ত্র-গণতন্ত্র দেবার অঙ্গীকারে
আমরা সবই মেনে নিলাম শান্তি আসতে পারে।
তারপরে কত ইতিহাস হলো নির্বাচন
ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা ক্ষুব্ধ জনগণ।
আমার কথার মূল্য কী আর পেলাম একটুখানি?
ভুট্টোর কথা মেনে নিলেন কেমনে বিচার মানি?

তিনি বলেন মার্চ মাসেতে বসবে অধিবেশন
মেনে নিলাম আমরা যাব হবে অনেক কথন।
আরও বলি ন্যায্য কথা কেহ যদি বলে
একজন সংখ্যায় বেশি হলেও আমরা জয়ী দলে।
ভুট্টো সাহেব এসেছিলেন চলল আলোচনা
আলোচনা করে গেলেন ছিলেন বহুজনা।
বলে গেলেন আলোচনার দরজা খোলা রবে
শুরু যখন আলোচনা আরও অনেক হবে।
নেতৃবৃন্দ সমাবেশে সঙ্গে আলাপ করি
আসুন বসুন সবাই মিলে শাসনতন্ত্র গড়ি।

ভুট্টো বলেন কেহ এলে হবে কসাইখানা
কেহ গেলে মারব তাকে শুনব নাকো মানা।
পেশোয়ার থেকে করাচি বন্ধ করা হবে
আমি বলি অধিবেশন আগের মতই রবে।
এক তারিখে অমনি হঠাৎ দিলেন বন্ধ করে
ইয়াহিয়া জনসভা ডাকেন কীসের তরে?
ভুট্টো বলেন চাই না যেতে আমি যাব বলি
পঁয়ত্রিশ জন পাক নেতারা অমনি এলেন চলি।
তারপরেও ফন্দি এঁটে হঠাৎ সভা থামায়
করল দোষী দেশের মানুষ করল দোষী আমায়।

দেশের মানুষ আমরা কঠোর প্রতিবাদে লড়ি
আমি বলি শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন করি।
কলকারখানা সকল কিছু বন্ধ করে দেব
সাড়া দিতে আপন মনে দৃঢ় শপথ নেব।
রাস্তাঘাটে বেরিয়ে যায় দেশের জনগণ
সংগ্রাম করে শান্তিপূর্ণ সবাই করি পণ।

পয়সা দিয়ে অস্ত্র কেনা কী পেয়েছি তাতে?
ভেবেছিলাম শত্রু থেকে রেহাই দিনে রাতে।
নিরস্ত্রদের প্রতিকূলে জীবন ধুকে ধুকে
সেই তলোয়ার আজ ব্যবহার মারছে গুলি বুকে।
আমরা জানি পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু ভাই
বাঙালি ক্ষমতায় যেতে চেষ্টা বৃথাটাই।
তখন ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে একি বর্বরতা?
টেলিফোনে আমার সঙ্গে হলো অনেক কথা।
বলেছিলাম ইয়াহিয়া আপনি দেখে যান
কত গরিব লোকের বুকে মারছে গুলিখান।

হঠাৎ ওরা না জানিয়ে গোপন বৈঠক ডাকে
আলোচনায় করল দোষী দেশের মানুষটাকে।
করল দোষী আমাকেও আলোচনা সভায়
পাঁচিশ তারিখ জনসভা কল করেছে আমায়।
শহিদ ভাইয়ের রক্তের ওপর চাই না পাড়া দিয়ে
আরটিসিতে যাব আমি কাকে সঙ্গে নিয়ে?

জনসভায় কল করেছে এই কথাটি বলি
আমার দাবি মানতে হবে তবেই গলাগলি।
পক্ষে আমার দাবি ছিল সুষ্ঠু অধিকার
করতে হবে এই সামরিক আইন প্রত্যাহার।
সামরিক সৈন্য ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে
কেমন করে হত্যা হলো তদন্ত হয় ক‌বে?
চাই ক্ষমতা জনগণের প্রতিনিধির কাছে
জনসভায় যাব কী-না বিবেচনা আছে।

চাই না আমি মন্ত্রী কোনো লোভ-লালসা নাই
দেশের মানুষ সুখে থাকুক চাই অধিকার চাই।
পরিস্কার অক্ষরে বলি আনব যদি ফাগুন
বাংলাদেশে সবাই জ্বালাও প্রতিবাদের আগুন।
বন্ধ রবে কোর্ট-কাচারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
বন্ধ অফিস অদালতও ধর্মঘটের গান।
দুখির যেন কষ্ট না হয় সেদিক রাখো খেয়াল
কাল থেকে আর নেই ওসবে ধর্মঘটের দেয়াল।
লঞ্চে রেলে নেইকো বাধা দাও যেখানে পাড়ি
চলবে পথে রিকশা রে ভাই চলবে ঘোড়ার গাড়ি।
সরকারি অফিসে শুধু ঝুলবে বড় তালা
রুখতে স্বদেশ দৃঢ় শপথ প্রতিরোধের পালা।

আটাশ তারিখ কর্মচারী বেতন নিতে যাবে
আশা করি কিন্তু সবাই ন্যায্য বেতন পাবে।
বেতন যদি না দেয়া হয় একটা গুলি চলে
কে ঠেকাবে করতে লড়াই হত্যা কেহ হলে?
আজ তোমাদের সবার প্রতি রইল অনুরোধ
ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ো জাগ্রত হোক বোধ।
তোমাদের যা কিছু নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা
ভয় করো না হতে পারে কভু মরণ খেলা!
আমি যদি হুকুম কোনো নাও দিতে পারি
প্রাণের তরে রাস্তা বন্ধ অতীব দরকারি।

ভাত পানিতে মারবো মোরা তোমরা আমার ভাই
অই ব্যারাকে যাও ফিরে যাও কিছু বলার নাই।
কিন্তু আমার বুকের ওপর আর করো না গুলি
সাত কোটি লোক কেমনে দাবাই ষড়যন্ত্র ধূলি।

মরতে যখন শিখে গেছি হলেন কেহ শহিদ
আবার কেহ জখম হলেন তবু বাঁচার তাগিদ।
আমরা লীগের পক্ষ থেকে যতটুকু পারি
হাত বাড়াব ওদের পাশে দাঁড়াই সারি সারি।
যদি পারেন অল্প টাকা রিলিফ কমিটিতে
আপন মনে পৌঁছে দিও মুখের হাসি দিতে।

সাতটি দিনে যত শ্রমিক ধর্মঘটে গেল শিল্প মালিক,শুনি যেন বেতন সবাই পেল।
সরকারি লোক তোমরা শোনো নয়কো বাড়াবাড়ি
যা বলি তা মানতে হবে অতি তাড়াতাড়ি।
এ দেশ যদি মুক্তি না হয় আমরা হুঁশিয়ার
খাজনা দেয়া বন্ধ করি কেউ দেব না আর।
শক্রসেনা সারা দেশে করল প্রবেশ আজ
বিবাদ সৃষ্টি করবে জানি করবে লুটতরাজ।

নেইকো বিভেদ ভাইয়ে ভাইয়ে হিন্দু মুসলমান
সবাই মিলে গাইতে হবে সাম্য প্রীতির গান।
করতে হবে দেখাশোনা মিলেমিশে থাকি
বদনাম যেন হয় না কোনো সদাই স্মরণ রাখি।
রেডিও বা টেলিভিশন মত যদি না শোনে সেইখানেতে কেউ না যেন যাবার সময় গোনে।
মাইনে -পত্র নিতে যেও ব্যাংকে প্রয়োজনে
ঘণ্টা দুয়েক থাকবে খোলা চলি আপন মনে। 

পূর্ব থেকে একটি পয়সা পশ্চিম পাকিস্তানে
চালান হতে পারবে না আর খেয়াল বামে ডানে।
এই টেলিফোন এই টেলিগ্রাম চালাও পূর্বদেশে
দূর বিদেশে পাঠাও খবর আমরা বীরের বেশে।
কিন্তু যদি কেউ আমাদের খতম করতে চায় বাঙালিরা বুঝেশুঝে হাত বাড়াবে তায়।

পাড়ায় পাড়ায় সংগ্রামেরই সভা গড়ে তোল
ভয় করো না অপরাধীর মুখোশ এবার খোল।
তোমাদের যা কিছু আছে সঙ্গে নিয়ে থাকো
রক্ত দিলাম আরও দেব মুক্তি ছবি আঁকো।
মুক্ত হবার প্রত্যাশাতে সংগ্রাম মানবতার
মুক্ত করে ছাড়ব প্রভু সংগ্রাম স্বাধীনতার। 

——————–­——————-
কনইল, ভীমপুর, নওগাঁ।
বি. এ. (অনার্স), এম. এ.
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। মোবাইল: ০১৭৪০-৬০২৭০৫

আপনার মন্তব্য লিখুন

Click here to post a comment