রঙের জীবন

অচেনা আপন || কাকলী ঘোষ

ঝড় উঠেছে -বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটাও পড়তে শুরু করল -অনীশা -তাড়াতাড়ি জানালার কাঁচের কপাট বন্ধ করল -ইতিমধ্যেই বৃষ্টির ছাঁটে বিছানার চাদর -টা ভিজে গেছে –

 

 

বিনি -অনীশার মেয়ে -পাশের ঘরে পড়ছে -বিনি ক্লাস -এইটে পড়ে -অনীশা পাশের ঘরে গেল -দেখে বিনি পড়ার টেবিলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে -ব্যালকনি -তে বৃষ্টিজলের ছাঁট -অনীশা দৌড়ে গিয়ে ব্যালকনির দরজা বন্ধ করল -না -হলে ঘর ভিজে যাবে -l ঘুমন্ত বিনি -কে কোনরকমে পাঁজা কোলা করে বিছানায় ফেললো l

রাত বাড়ছে -রঞ্জনের আসার সময় হয়ে এল l

 

রঞ্জন পেশায় ইঞ্জিনিয়ার l এছাড়া একটা কম্পিউটার সেন্টার আছে ওর l কেন যে আজ আসতে দেরি হচ্ছে ওর l ফোন করবে কী -অনীশা ভাবে -পরক্ষণে ভাবে -থাক চলে আসবে l বৃষ্টিটা বেশ জোরে পড়ছে -কোথাও কী আটকে গেছে ও l এইসব সাত -পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যেন সে তেপায়া টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল l

“অনীশা -ঘুমিয়ে গেলে -আজ একটু দেরি হয়ে গেল আসতে l”-রঞ্জনের গলার স্বরে ধড়মড়িয়ে উঠল অনীশা lদেয়াল -ঘড়ির দিকে চোখ চলে গেল ওর -রাত্রি -দুটো বাজে l “কখন এলে রঞ্জন -চোখ -টা কখন লেগে গেছিল বুঝতে পারি নি l “-অনীশা বললl রঞ্জন উত্তর দিল -“এইমাত্র এলামl”-অনীশা অবাক হয়ে বলল -“এত রাত -কেন -আর তুমি ঘরে ঢুকলে কী করে ? সদর দরজা তো বন্ধ l “তুমি দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছিলে অনীশা -আজ আসার পথে লেভেল ক্রসিং -এ এক বিরাট অ্যাকসিডেন্ট -একটা মেল ট্রেন ঝড়ের বেগে এসে একটা মারুতি গাড়িকে একেবারে চিড়েচ্যাপ্টা করে দিল -গাড়ির চালক -মালিক স্পটডেড l -কিচ্ছু করার ছিল না -সিগনাল বিভ্রাট ছিল -তার এক মিনিট আগেই আমি লেভেল ক্রসিং পার হয়েছিলাম l শুধু এক মিনিটের ফারাক -l “কী বলছ তুমি -“-অনীশা ঘুরে ভাল করে তাকাল রঞ্জনের দিকে -চমকে উঠল ও -“একি রঞ্জন -তবে তোমার শার্ট মুখ -হাত সব এমন রক্তে ভেজা কেন -তোমাকে এমন অন্যরকম লাগছে কেন ?”অনীশা কেমন ভয়ার্ত চোখে বলল l রঞ্জনের চোখ দুটো যেন আজ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে l “ও -কিছু না -ওই ডেড বডি -টেনে গাড়ি থেকে বার করতে গিয়ে সব জায়গায় রক্ত লেগেছে l তুমি কিছু ভেবো না -আর অনীশা একদিন তো সকলকেই যেতে হয় l যদি আমি না থাকি -তুমি বিনি -কে মানুষের মত মানুষ করেl

 

অনীশা কেমন হতভম্ব হয়ে হা করে শুনতে থাকে রঞ্জনের কথা l কেমন যেন অচেনা লাগছে ওর আজ এই এতদিনের চেনা -বড় কাছের মানুষটাকে l রঞ্জন শুধু হাসাতে জানে -খুব ভাল মানুষ -পরোপকারি -কিন্তু আজ ও এমন কথা বলছে কেন ?–ভাবতে ভাবতে সম্বিত ফিরল অনীশার l হঠাত্ কারেন্ট চলে গেল -l “রঞ্জন -রঞ্জন -কোথায় -কোথায় তুমি -তোমাকে ছুঁতে চাই l”-আমি বিনির কাছে যাচ্ছি অনীশা -শেষ আদর করব আমার মাকে -নাহলে যে শান্তি পাব না আমি l”-

“রঞ্জন -কী বলছ -তুমি -ইনভার্টlর -এ চার্জ ছিল তো -আলো জ্বলছে না কেন -আমার ভয় করছে l “-তুমি এত ঘুটঘুটে অন্ধকারে কী করে যাচ্ছ বিনির ঘরে -অন্তত মোবাইলের আলোটা জ্বালোl ” –

“ওটা আজ হারিয়ে গেছে অনীশা -তবে এখন আমি আলো ছাড়াই বেশ দেখতে পাই l”-কী ঠাণ্ডা শোনাচ্ছে রঞ্জনের গলাটা আজ l কোনরকমে নিজের মোবাইল হাতড়ে টর্চ জ্বালাল অনীশা l দৌড়ে গেল বিনির ঘরে -কোথায় -কোথায় রঞ্জন -বিনি চিত্কার করছে -“মা -মা -বাবা কোথায় গেল -আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল বাবা ,কোথায়-কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না কেন-কী অন্ধকার l “-লাইট জ্বলে উঠল l কই রঞ্জন -কেউ নেই -তবে কী সব স্বপ্ন ছিল -কিন্তু অনীশা যে সব স্পষ্ট দেখেছে -রঞ্জন রাতে কী ফেরেনি -?—-কোকিল ডেকে উঠল কোথায়—–

 

ক্রিং ক্রিং ক্রিং –অনীশার মোবাইল বেজে ওঠে l ও দৌঁড়ে গিয়ে রিসিভ করে কল -টা -l অপর পার থেকে ভেসে আসে এক অচেনা কণ্ঠস্বর -“হ্যালো -মিসেস সান্যাল বলছেন কী?”—অনীশা কী এক অস্বস্তিতে উত্তর দেয় -“হ্যাঁ -কে -বলছেন ?”-

“আমি বিরাটি থানার অফিসার ইনচার্জ বলছি -একটা ব্যাড নিউজ আছে -আপনার স্বামী -মিস্টার রঞ্জন সান্যাল গত রাতে লেভেল ক্রসিং পার হতে গিয়ে দিল্লীগামী এক মেল ট্রেনের ধাক্কায় -মারা গিয়েছেন -l দয়া করে স্পটে এসে দেহ সনাক্ত করুন l”—-

অনীশা বাকরুদ্ধ -কেঁপে ওঠা হাত থেকে মোবাইল -টা ছিটকে পড়ে গেল -“রঞ্জন –রঞ্জন –বিনিইইই –“– বেরিয়ে এল ওর আর্ত চিৎকার -আর ঘরের মেঝের দিকে চোখ যেতেই ঝাপসা চোখে ও দেখল -মেঝেতে তখনও পড়ে আছে বেশ টাটকা রক্ত —-l

 

দুর্গাপুর -বর্ধমান,ভারত