জীবনের গল্প রঙের জীবন

অন্তহীন অপেক্ষা || কাকলী ঘোষ

তাহেরা ধড়মড় করে উঠে বসল বিছানায় l আজ খুশীর ঈদ -কাল রোজা শেষ হল l তাহেরার অবশ্য তেমন কোন মাথাব্যথা নেই l এমন উপবাস ,বা আধা রোজা ওকে প্রায়ই করতে হয় ওর বৃষ্টির জলে ভাসা জীর্ণ কুঁড়েতে l বাবুর বাড়ি কাজ করে খায় ও l নুরিন -আর ওমর -দুই ছোট্ট ছেলেমেয়েকে খাইয়ে নিজের জন্য অনেক সময়ই কিছু থাকে না ওর l
ওদের আব্বু -রহমান সেই গতবার বান ডাকলো পদ্মায় ,সেই থেকে নিখোঁজ l ইলিশের মরসুম ছিল l সব জেলেমাঝি ফিরে এলো -এলো না কেবল রহমান l তাহেরার বুকের ভিতরটা সেই আগের খুশীর দিনগুলি -খুশীর ঈদের কথা ভেবে হু-হু করে যন্ত্রণায় l
আজ বাবুর বাড়িতে কতো আনন্দ l সবাই নতুন পোশাকে সাজবে l বিশাল বাড়িটা আলোর মালায় রূপসী মেয়ে হবে l আর কত রকম সুস্বাদু খাবার -মিষ্টি -নুডলস কত কী l ওকেও একটা শাড়ি দিয়েছে ওরা l ও -নুরুল ভাইজান-এর দোকান থেকে ধার করে ছেলেমেয়ে দুটোর জামা এনেছে l
তাহেরার দুই চোখ জলে ভরে উঠলো l ও ভাবে আল্লাহ্ কোথায় আছেন ?ও তো রোজ পবিত্র আত্মায় মনপ্রাণ ঢেলে নমাজ পড়ে -তসবিহ গোণে ,কই তাঁর কানে কী ওর প্রার্থনা পৌঁছায় না ?ওর জন্য কী তাঁর ইনসাফ -এর দরজা বন্ধ ?

আবার ইলিশের মরসুম এসে গেল l রহমান -এর জন্য অন্তহীন অপেক্ষা ওর l ও স্বপ্ন দেখে ,রহমান ফিরে এসে বলছে ,”কই গো নুরিনের মা -কোথায় গেলা -আজ একখান বেশ বড় ওজনের ইলিশ পাইছি -বাজারে বেশ দর উঠব -দেইখ্যl “-
তাহেরা ভোরে নেয়ে এসেছে নদীতে -দুই ছেলেমেয়েকেও স্নান করিয়ে -আজ সালেমার বাড়ি রেখে কাজে গেল ও l ওদের বলে গেল সন্ধ্যায় ওদের জন্য অনেক বরফি -মিষ্টি -নুডলস নিয়ে আসবে l ছোট্ট নুরিন -ওমরের খুশী আর ধরে না আজ l
সারাটাদিন ছেলেমেয়ে দুটোর জন্যে ছটফট করে গোধুলির রাঙা আলোয় বাড়ির পথ ধরল তাহেরা l পথে কেউ কেউ বলল -“ঈদ মুবারক :”l

আজ ছেলেমেয়ে দুটোকে পেট পুরে ভালমন্দ খাওয়াবে ও -ওমরটা খুব ন্যাওটা ওর -আঁচল টেনে রাখে শুধু , এসব ভাবতে ভাবতে কখন ওর কুঁড়ে ঘরের সামনে এসে গেছে ও l কিন্তু ওর ঘরের সামনে আব্দুল চাচা ,ফতিমার মা আরও সবাই ভিড় করেছে কেন ?ওরা কাঁদছে কেন ?ওকে দেখামাত্র চুপই বা হয়ে গেল কেন ?ভিড় ঠেলে ঘরে ঢোকে ও l নুরিন ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে l তাহেরা কেমন যেনো কিছুই না বুঝে বলে ,”কী হয়েছে মা -কাঁন্দস ক্যান -পোলাটা কোহানে ?এত্ত মাইনসে কী করতাসে -কার কী হইসে ?তোগো লাইগ্যা কত্ত মিঠাই আনসি -দেইখ্যা ল lওমর -ও খোকা —–“:

নুরিন মাকে জড়িয়ে কেঁদে বলল শুধু -“কারে ডাক আম্মি -ভাইজান বায়না কইরা রহিম চাচার লগে নদীতে গেছিল l ওরে পাড়ে রাইখ্যা চাচা জাল ফেলতাছিল নদীতে l একসময় একখান হঠাত্ জলের তোড় আসে -কোনরকমে টাল সামলাইয়া চাচা ঘুইরা দেখে ভাইজান পাড়ে নাই l বহু খুঁজ্যাও ওর সাড়া মেলে নাই -গো —”
সারা বিশ্বচরাচর শূন্য হল আজ খুশীর ঈদে -এক নেহাতই অখ্যাত গাঁয়ের হতদরিদ্র মায়ের কুটিরে -শুধু একটা চিৎকার মাতৃহৃদয়ের হাহাকার ছিঁড়ে কাঁপিয়ে দিল ঈদের আকাশ বাতাস -“খোকন ——-“-সব খাবার তাহেরা র অচেতন শরীরের হাত থেকে ছড়িয়ে -ছিটিয়ে পড়ল মাটির ঘরে l
আল্লাহ্ -র কাছে ইনসাফ -এর প্রার্থনায় খুশীর ঈদে তাহেরার পাওনা হল আর একটা নতুন অনন্ত অপেক্ষা l

দুর্গাপুর -বর্ধমান, ভারত