জীবনের গল্প রঙের জীবন

বিনির কথা || পিতাম্বর ধনঞ্জয় ঘোষাল

বিনি আমার ছেলেবেলার সাথী। আমরা একই পাড়ায় থাকতাম।একই সঙ্গে বড় হয়েছি ছোট থেকে। এক সাথে নদীতে স্নান করা , এক সাথে ইস্কুলে যাওয়া , এক সাথে খেলা –বিনি আর আমি মানিকজোড় ছিলাম।

আমি ইস্কুলে বকুনি খেলে বা স্যারের হাতে মার খেলে –বিনি আমার সাথে কথা বলতো না বেশ কিছুক্ষণ , তারপর কাঁদতে শুরু করত। কারো সাথে কথা বলতো না। আমি কিছুতেই বুঝতাম না -বিনি কেন এমন করে ? মার তো খেলাম আমি ! আমি খুব রাগ করতাম। আমি ওর সাথে আড়ি দিয়ে দিতাম। মাসের মধ্যে কুড়ি দিন ওর সাথে কথা থাকতোনা।

অথচ রোজ সকাল দুপুর সন্ধ্যে ওদের বাড়িতেই থাকতাম। বিনির মা আমাকে খুব ভালবাসতেন। সন্ধ্যেবেলায় যেই ওদের ঘরে ঢুকতাম সঙ্গে সঙ্গে ওর মা চেঁচিয়ে ডাকতো –“বিনি ! বিল্টু এসেছে ! ও তো আবার বড় লোকের বেটা,চা খায় না।কড়াই থেকে এক গ্লাস দুধ দে , আর ও এক্ষুনি ছুঁয়ে দেবে , দুধের সর টা তুলে একটু চিনি মাখিয়ে দে –“।

 

আমার তো তখন ওর সাথে কথা বন্ধ। ও দেবে কেন? বিনিও চেঁচিয়ে ওর মাকে উত্তর দেয় — ” আমি কারো চাকর নই , যার দুধ খাওয়ার এত শখ তাকে নিতে বলুন “। মুখে বললেও বিনি কিন্তু এক গ্লাস দুধ আর সর চিনি শুকনো মুড়িতে মাখিয়ে দিল।

বিনির সাথে আমার সম্পর্কটা এরকমই ছিলো।আমাদের বাগানে অনেক আতা গাছ ,অনেক নোনা আতা আমাদের গ্রামীণ নাম ছিলো ডেউ মাদার। আতার গুটি হতো আর ডেউ মাদারের গুটি ছিলো না ,খুব মসৃণ ।

ভেতরে অনেক শাঁস থাকত ।একটা মস্ত ফলসা গাছ ছিলো , একটা নোড়া জামের গাছ ,চালতা গাছ, নারকোল গাছ তিনটে ,দুটো ডালিম গাছ , ছয়টা আম ,দুটো কাঁঠাল গাছ দু ঝাড় কলা, পঞ্চাশটা বিশাল বিশাল তাল গাছ আর অসংখ্য বাঁশ ঝাড়। আর ছিলো অনেক কলকে ফুলের গাছ , অনেক বাসক ,অনেক ঘেঁটু , অনেক দ্রৌনপুষ্প , মুথো ,ডাংগাডোংগা আরো অনেক অনেক কিছু । অনেক পাখি ছিল। কলকে ফুলে যে ছোট্ট পাখিটা লম্বা ঠোঁট ঢুকিয়ে মধু খেত –ও তো আমার বন্ধু ছিলো। আমরা একসাথে মধু খেতাম আর মা চেঁচিয়ে পাড়া মাত করতো। ” – লক্ষীছাড়া ছেলে ফুলের পোকা মুখে ঢুকে যাবে – আয় ওখান থেকে – ” ।

 

বিনি আর আমি সারা দুপুর আমাদের বাগানে খেলতাম। প্রজাপতি ধরতাম।তারপর হঠাৎই কেন যে আড়ি হয়ে যেত ? তারপর মুখ ফুলিয়ে ও চলে যেত , আর আমিও মন খারাপ করে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ছোট ছোট আগাছা গুলোকে কচ কচ করে কাটতে থাকতাম। তখন বিশ্বের যাবতীয় ঘৃণা ,বিদ্বেষ সব —ওই সব ছোট ছোট গাছ গুলোর উপর পড়ত । বিনির অভিমানে আমি কত বার নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করেছি -রক্ত ঝরিয়েছি, শুধু ও এসে কাঁদবে আর দৌড়ে গিয়ে কাপড় ছিঁড়ে নিয়ে এসে বেঁধে দেবে,এই আশায় ।

কতবার আমি ইচ্ছে করে গাছের ডাল থেকে পড়ে গেছি – শুধু বিনিকে কষ্ট দেব বলে। গলায় খাবার আটকে যাওয়ার কত যে মিথ্যে অভিনয় করেছি ; আজ ভাবলে হাসি পায়।

সেই বয়সটা কিন্তু প্রেম করার মতো ছিলো না। তবুও আমি ওর কাছকাছি থাকতে চাইতাম , আমার মনে হয় ও-ও হয়তো তাই চাইত। কি জানি ? হবেও বা ।

 

বিনিও একদিন হঠাৎ বড় হয়ে গেল ! আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলামনা বড় হওয়া মানেটা কি ? কেন ও এক্কা দোক্কা খেলবে না ?

কেন ও লুকোচুরি খেলবে না ? কি এমন হল ?

আমি যে ওকে ছাড়া আর কারো সাথে খেলতেই পারবনা। বিনিকে বাদ দিয়ে সাঁতার কাটা , বিনিকে বাদ দিয়ে কুয়োতলায় বসে ডাঁসা ডাঁসা পেয়ারা খাওয়া যায় ? দু জানে হাত ধরা ধরি করে কাল বোশেখির ঝড়ে আম কুড়ুতে যাবার যে আনন্দ সেকি অন্য কারো সাথে হতে পারে ? অমনি বলেদিলেই হল ? ও যাবে না । ও বড় হয়ে গেছে ।

সেই রাগেই তো দুপুর বেলায় একলা পেয়ে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কষিয়ে এক ঘা মেরেছিলাম ঠিক কোমরের পাশে। ও খুব কেঁদে ছিল ।কিন্তু বলেনি কাউকে। বললে হয়তো আমার পিঠেও পড়ত ঘা কয়েক । কিন্তু বিনি তো কখনও তা চায় নি । তাই নিঃশব্দে চলে গিয়েছিল ।

হঠাৎ করে বিনির বড় হয়ে ওঠাটা আমাকে ভীষণ কষ্ট দিল। আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। প্রায়ই ওকে কাছে টেনে মাথায় মাথায় মাপ নিতাম আর প্রতিবারই আমি বিনির থেকে বেশ লম্বা।আমি খুশি হয়ে ওর মাকে বলতাম –” কোথায় ও বড় ? আমি ওর চে’ ঢের বড় !” সবাই হাসতো -আমার বোকামি দেখে বা ছেলেমানুষী দেখে। কেবল আমার অবুঝ মন বুঝতে চাইত না

 

এরপর একটা নতুন ঘটনা আমাকে , আমার ভেতরের শিশুকে এমন জখম করে দিল যে আমি একবার ভেবে ছিলাম আমি মরে যাবো।কিন্তু কি করে মরা যায় ? এটাই তো জানতাম না। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এলো । যেমন ভাবা তেমন কাজ। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন বিনি নদীর ঘাটে আসে! ও এলো , প্রায় ঘন্টা খানেক পরে –কাঁখে কলস ,কাঁধ আর বুক জড়িয়ে লাল গামছা –

আমি ধীরে ধীরে ওর কাছে গেলাম এবং খুব দৃঢ় ভাবে বললাম — “বিনি তুই জানিস কেমন করে মরা যায় ” ? ও ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে –” খুব আস্তে করে বললে — কেন ? কে মারা গেছে ? আবার তুই শ্মশানে গেছিলি ? ” আমি কেমন মরিয়া হয়ে বললাম –” আমি মরব । তাতে তোর কি নেংটি ইঁদুর ?

যা এখান থেকে। আমি তোর সাথে কোনও কথা বলবো না! তুই বড় হয়ে থাক। আমি বড় হতে চাই না।তা ছাড়া আমি এমনিতেই তোর চে ‘ অনেক লম্বা। দেখবি আমি কাল থেকে আর আসব না। যাঃ যাঃচলে যা এখান থেকে

আমার সাথে কথা বলবি না – বলেদিলাম — কি আমার বড় রে ?”

 

এ ভাবেই বিনির মেয়ে বেলা শুরু , আর আমার অব্যক্ত অভিমানের বয়সসন্ধির বেলার আরম্ভ। আমাদের গ্রামের ইস্কুলটা তখন জুনিয়র হাই ইস্কুল ছিল। ক্লাস এইট অব্দি ছিল। নাইন থেকে গ্রাম থেকে চার কিলো মিটার দূরে অন্য গ্রামে পড়তে যেতে হতো।আমরা ছেলে , তাই আমরা ওখানেই ভর্তি হলাম । কিন্তু বিনি তো মেয়ে ! তাই ওর পড়া ওখানেই শেষ ।আমি রোজ ইস্কুল থেকে ফিরে ঝটপট খাবার খেয়ে ছুটতাম খেলতে , বা কোনোদিন ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে । আমি মাছ ধরতে যাবার সময় কতক গুলো ডিটেকটিভ বই নিয়ে যেতাম। স্বপন কুমার সিরিজের বই আমার খুব প্রিয় ছিল । আমি তো মাছ ধরতাম না , বই পড়তাম। সন্তুদা বা কুচু ফাৎনা টা ডুবে গেলে টেনে তুলত আর গালাগাল দিতো। কখনও সখনো দু _একটা পুঁটি বা দাঁড়কে মাছ উঠে যেত , তাতে আমার কোন কৃতিত্ব থাকতনা। অক্লান্ত পরিশ্রম করে সন্ধ্যে নাগাদ বাড়ী ফিরতাম চারটা কিম্বা পাঁচটা মাছ নিয়ে।

বাড়ি ফিরেই যেটা হতো সেটা আর না বললেও বুঝতে খুব অসুবিধে হবার নয়।

 

এভাবেই আমার হায়ার সেকেন্ডারি শেষ হল। যেদিন আমার রেজাল্ট বের হল আমি খুশিতে ডগমগ হয়ে বাড়ি ফিরলাম। বাড়িতে ঢুকেই মাকে প্রণাম করলাম। মা বললো – ” খাবি কিছু ?” আমার তো তখন বিনির কাছে যাওয়ার কথা। কিন্তু গত তিন মাস ধরে তো ওর সাথে কথা বন্ধ। কিন্তু ওকে না বললে তো এই পাশের কোন মূল্যই নেই। ভাবছি সাত-পাঁচ। কি ভাবে ওর সাথে কথা বলা যায় ? হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি এসে গেল। মা কে বললাম –” মা আসছি ” । বলেই দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম –

বিনিদের বাড়ী। আমি জানতাম ও আর ওর খুড়তুতো জেড়তুতো সব দিদি আর বোন রোজ ওই সময় নদীতে যেত গা-ধুতে। আমি সোজা উঠোন পেরিয়ে ওদের ঘরে ঢুকেই ওর মাকে প্রণাম করলাম। ওর মা হঠাৎ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলে –“কে -কে রে ? ” তারপর আমায় দেখে বললে -” দিলি তো ছুঁয়ে ? এখনো সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালান হয়নি “। আমি ঘরের চার পাশটা দেখছিলাম। আসলে আমি বিনিকে খুঁজছিলাম। ওর মা -ই বললে -” বিনি এখুনি আসবে -বস একটু । দু-জনে তো কথা নেই আড়ি। কি করে রেজাল্ট জানাবি “?

এমন সময় ওরা ফিরল। আমি সব অভিমান জলাঞ্জলি দিয়ে বিনির সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু সেটা হল না। ওর

মা-ই বললে — “বিনি দেখ বিল্টু কেমন এক চান্সে এচ এস পাশ করে গেছে “। বিনি কোন কোন উৎকসাহতো দেখালই না , উল্টে মুখটা এমন করলে যেন পাশ করার মধ্যে কৃতিত্বই নেই ।

আমি খুব গম্ভীর হয়ে আস্তে করে বললাম –

” আসছি “। বিনি বললে–” বাবুর রাগ ষোলআনা। চল ছাদে চল ।আমি আসছি “।

আমি চুপচাপ ছাদে গিয়ে বসলাম -কার্নিসের উপর। মিনিট দশেক পর বিনি একটা থালাতে দু কাপ চা আর একবাটি সর মুড়ি নিয়ে এলো।

আমি কোনদিন বিনিকে সরের ভাগ দিই নি। সেদিন কিন্তু একসাথে খেলাম।

 

আসলে বিনি মানেই ডুরে শাড়ি ,বিনি মানেই কাঁখে কলসি , বিনি মনেই আমার ছেলে বেলা , বিনি মনেই আমার স্বাভাবিকত্ব ,

বিনি মানেই নদীর স্বচ্ছ জল , বিনি মানেই অন্ধকারের আলো , অথচ ও যেদিন দুপুর বেলায় আমার পড়ার ঘরে কপাট ঠেলে ঢুকলো –আমার তখন খ্রিস্টিয়ান কলেজে ফার্স্ট ইয়ার । তখন ওর সাথে আমার পাঁচ মাস কথা ছিলনা। ও হঠাৎ কপাট খুলে –“বলল -কি রে আমার সাথে কথা বলবি না”? আমার তখন বুকের ভিতর হাতুড়ি চলছিল। আমার গলা মুখ জিভ শুকিয়ে কাঠ। আমি কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। অনেক কষ্টে আমি বললাম –” ছিঃ। এমন করে বলিস না। তুই কি আমার পর ? আয় বোস বোস এখনে” । আমার ওকে ছুঁতে খুব ইচ্ছে করছিলো। ওর হাত আমার হাতে রাখতে ইচ্ছে করছিল , জড়িয়ে ধরতে মন চাইছিল।

বিনি কুণ্ঠিত ভাবে আমার পাশে বসলো। তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর খুব মৃদু স্বরে বলল — আমার বিয়ে জানিস তো “?

– ” হ্যাঁ ” আমি ঢোক গিলে বললাম। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। অনেক কথা বলার ছিলো , অনেক -অনেক- অনেক ব্যাথা জমে আছে। কিন্তু বলা হলনা।

 

সে কথা শুনিবে না কেহ আর ,

নিভৃত নির্জন চারি ধার ।

দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি ,

আকাশে জল ঝরে অনিবার —-

জগতে কেহ যেন নাহি আর ॥

 

সমাজ সংসার মিছে সব ,

মিছে এ জীবনের কলরব ।

কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে

হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব

আঁধারে মিশে গেছে আর সব ॥

 

বিনির বিয়ে হয়ে গেল। বিনি খুব ভালো আছে।খুব সুখে আছে। বেদনাবিহীন জীবন।

 

যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে…

সে কথা আজি যেন বলা যায়…

 

শেষ কথাটা বলা হলনা…… শেষ কথটা…….

 

শোনাও হলনা। বিনি ——আমি তোকে

ভালবাসতাম কিনা জানি না, সত্যিই জানিনা।

 

 

পশ্চিমবঙ্গ,ভারত