জীবনের গল্প রঙের জীবন

হীরা মাসী || পিতাম্বর ধনঞ্জয় ঘোষাল

হীরা মাসীকে কোনদিন ভুলতে পারবনা।আসলে হীরা মাসী তো আমার মাসী হতো না।গ্রাম সম্পর্কে আমিই ওর মামা হতাম। যেহেতু ও আমার চেয়ে সাত আট বছরের বড় ছিলো তাই আমি ওকে মাসী বলে ডাকতাম।

হীরা মাসির আমাদের গ্রামে মামা বাড়ী। ওরা জাতিতে কর্মকার।ওদের বাড়িতে হরদম দুম দাম ঠক ঠাক শব্দ হতো।সারাদিন গরুর গাড়ির চাকার লোহার বেড় বা কোদাল বা কাস্তে এই সব তৈরী হতো।

 

ওরা খুব গরীব ছিলো ,তাই ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ার ফলে মামা বাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। মামারাও বিশেষ অবস্থাপন্ন ছিলো না ,সেই জন্য ওরা পড়া শুনাও হয়নি কিছুই। কিন্তু হীরা মাসী এতো ভালো আর পরোপকারী ছিলো যে ওকে সবাই খুব ভাল বাসতো। বিশেষ করে আমার মা। মা-ই ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে কাজ করার জন্যে। ওর বয়স তখন সোলো -সতেরো হবে আর আমি তখন নয় বছরের ।

ও আমাদের বাড়ির সমস্ত কাজ একলাই করে ফেলত,মা বা বড় বৌদি কোন কাজ করতে গেলে দৌড়ে এসে হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলতো –” আমি করে দিচ্ছি তো !” আর সেইজন আমাদের বাড়ির সবার কাছে হীরা মাসী ভীষণ প্রিয় ছিলো। আর আমার খেলার সাথী ,ঝগড়ার সাথী ,দুষ্টুমি করার সাথী –সবেতেই হীরা মাসী। ও না হলে চলত না। আমার ইস্কুল যাবার সময় ও আমার সাথে সাথে অনেকদূর অব্দি যেত । কোনোদিন কজের চাপে না গেলে আমার সেদিন ইস্কুল যেতেই ইচ্ছে করতনা।

 

গ্রীষ্মের দুপুরে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত আমরা তখন চুপি চুপি আম চুরি করতে যেতাম ,কখনও পেয়ারা কখনও বা তেঁতুল চুরি করে নুন লঙ্কা মেখে খেতাম ।

এ ভাবেই বেশ কাটছিল। হঠাৎ ওর মামা এক বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এলো।যতই হোক মেয়ে বলে কথা। বিয়ে তো দিতেই হবে। অতএব সবাই মিলে চাঁদা করে বা সাহয্য করে ওর বিয়ের ব্যবস্থা হল। মুশকিলটা হল আমদের। ও তো কাজের মেয়ে ছিলনা।আসলে ও ছিলো আমাদের বাড়ির অভিভাবক। বাবার কখন চা চাই , হীরা মাসী জানত , আমি বিকেলে কি খাই তাও ও জানত। মায়ের পান জর্দা ,সুপুরি কেটে দেয়া –সব সব ও জানত। পৌষ পিঠের আগের দিন কাক ভোরে উঠে স্নান করে ভেজানো চাল ঢেঁকিতে গুঁড়ো করতো আর আমি ওর কাছে ঘুর ঘুর করতাম। তারপর সন্ধ্যের পর নারকোল ফাটিয়ে আমায় ডাকতো -“মামা একটা বাটি নিয়ে আয়

নারকোলের জল খাবি না ?”

সেই হীরা মাসির বিয়ে হয়ে গেল। যেদিন বিদায় হল আমি এতো কেঁদে ছিলাম —ও রকম কান্না বোধ হয় আর দুবার কেঁদে ছিলাম। একবার হীরা মাসী বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করার সময় আরেকবার মা মারা যাবার সময়।

হীরা মাসী কেন বিষ খেয়েছিল ? কেউ জানেনা –শুধু আমি জানতাম। আমি যে ওর মামা ছিলাম – আমি যে ছেলেবেলার সাথী ছিলাম। আমি ওর বন্ধু ছিলাম।

সেদিনটা আমার খুব মনে পড়ে।দুপুরবেলা।আমরা ক জন বন্ধু বট তলায় বসে তাস খেলছিলাম — হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি কান্নার আওয়াজ।

তার মাঝে কে যেন বললো -“হীরা মাসী বিষ খেয়েছে “—আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেল হঠাৎ।আমি ঠিকমত দাঁড়াতে পারছিলামনা।সেই অবস্থাতেই ছুটতে ছুটতে গেলাম ওদের বাড়ি । ও তখনও বেঁচে ছিলো। মুখ থেকে গ্যাঁজলা বের হচ্ছিল। কেঁপে কেঁপে উঠছিল মাঝে মাঝে। কে যেন বললো হীরি ফলিডল খেয়েছে। হে ভগবান ! ফলিডল তো তীব্র বিষ ! আমরা তৎক্ষনাৎ একটা রিকশা ভ্যানে ওকে তুলে ছুটতে শুরু করলাম বাঁকুড়া মেডিকেল কলজেরে দিকে— সে প্রায় ছ মাইল রাস্তা তার উপর নদী। যদিও জল ছিলনা।

 

আমি হীরা মাসীর মাথাটা আমার কোলে নিয়ে বসেছিলাম।ওর মুখ থেকে যে ফেনা বের হচ্ছিল –কি ভীষণ তীব্র ঝাঁজাল গন্ধ -আঁশটে আঁশটে গন্ধে আমার বমি আসছিল। তবুও আমি বার বার দু হাত দিয়ে ওই ফেনা মুছে দিচ্ছিলাম। আর অনর্গল কথা বলছিলাম। কিন্তু না ! হীরা মাসী আমার কোলেই মারা গেল। আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। হীরা মাসির দেহ নিয়ে ফিরে এলাম আমরা।

 

আজও আমার হাতে আঁশটে গন্ধটা রয়ে গেছে। ফলিডলের তীব্র কটূ গন্ধ আমি আজও ভুলতে পারিনি।

হীরা মাসী আমি আজও তোকে ভুলিনি। এখনও দুখের দিনে তোর কথা খুব মনে পড়ে।

ক্রমশ…

 

আমরা তো ফিরে এলাম হীরা মাসীর দেহ নিয়ে। তখন সারা পাড়া ময় কানাকানি। হীরা কেন বিষ খেল? কে ওকে বিষ খেতে বাধ্য করল? সে এক বিশাল জল্পনা।আমরা কজন তখন বাঁশ কাটতে শুরু করে দিয়েছি, কেন না অস্বাভাবিক মৃত্যু। কেউ যদি পুলিশে খবর দিয়ে দেয়, তাহলে তো বেশ ঝামেলা হয়ে যাবে।

সেই সময় আমার বাবা ছিলেন গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান,মনে মনে এইটুকু ভরসা ছিল– বাবা তো আছেন ! কিছু একটা ভালো হবেই।

যা ভেবে ছিলাম ঠিক তাই হল।পুলিশের জীপের শব্দ শোনাগেল।পুলিশ প্রথমেই এলেন আমাদের বাড়ি।তারপর ঘন্টা দুয়েক আলাপ আলোচনর পর অনুমতি পাওয়া গেল শর্ত স্বাপেক্ষে– গ্রামের ডাক্তার বাবুকে দিয়ে একটি ডেথ সর্টিফিকেট জমা দিতে হবে।সব ভালয় ভালয় মিটে গেল।সেই মহুর্তে বাবাকে ঈশ্বর মনে হচ্ছিল।

এরপর আমরা সকলে হীরা মাসিকে নিয়ে চললাম শ্মশান ঘাটের পথে।মাত্র আড়াই ঘন্টায় হীরা মাসী ইতিহাস হয়ে গেল।

 

ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বট তলায় বসলাম–কিচ্ছু ভালো লাগছিলোনা ,

কে যেন কানের কাছে বলল -” মামা নারকোলের জল খাবি ?” আমি চমকে উঠে এদিক ওদিক দেখতে লাগলাম। কে বলল ? হীরা মাসী? আমার ভয় লাগতে শুরু করে –আবারও কে যেন বলল –” মামা তুই কোথাও চলে যাবি না তো?” হীরা মাসী মারা যাবার দিন কয়েক আগে

আমি কলেজ থেকে ফিরেই ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। তখন বিকেল বেলা।

 

হীরা মাসি কিছু একটা করছিলো , হঠাৎ আমায় দেখে অবাক হয়ে বলে ” মামা চা খাবি ? কলেজ থেকে এখনই এলি বুঝি? ” আমি বললাম –” মাসী ! চল বাগানে বসবি ?” –“এই সন্ধ্যেতে ? ” আমি বললাম- “সন্ধ্যে হয়নি তো “? কিছু ক্ষণ ভেবে বলল –“চল। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে কিন্তু”।

ওদের বাগানে অনেক ফলের গাছ ছিলো। আমার প্রিয় বাতাবীলেবুর কয়েকটা গাছ ছিলো।আমি প্রায়ই চুরি করে বাতাবী খেতাম।হীরা মাসী হঠাৎ আমায় বললে — “মামা আজ তুই না খেয়ে কলেজ গিয়েছিলি”?

আমি কিছু বললাম না। ও নিজেই বলল –” আমি জানি সকালে খুব ঝগড়া হয়েছিল আর তুই না খেয়ে কলেজ চলে গিয়েছিলি”। আমি হঠাৎ বলে ফেললাম –” হীরা মাসী আমি চলে যাবো কোথাও , আমার এখানে ভালো লাগেনা। আমি যদি একবার চলে যাই আর কখনও ফিরবো না “। হীরা মাসী খানিকক্ষণ চুপ চাপ আমাকে দেখল , তারপর বলল –” চা খাবি ? দুধ নেই লাল চা খেতে পারবি “? আমি বললাম –” না

চল বাড়ি যাই। সত্যি আমি একদিন চলে যাবো “। আমি হন হন করে চলে এলাম।ব্যস্ হীরা মাসীর সাথে সেই আমার শেষ কথা।

 

পশ্চিমবঙ্গ,ভারত