জীবনের গল্প

স্মৃতিতে আলতাফ মাহমুদ || রকিব ডি এম

বাবার ইচ্ছা ছেলে হবে ডিসট্রিক্ট বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু ছেলের বিন্দুমাত্র মন নেই লেখাপড়ায়, তার সারাদিনের ধ্যান জ্ঞান হলো গান আর ছবি আঁকায় । গানের প্রতি এই ঝোঁকটাই একসময় তাকে নিয়ে যায় বহুদূর এবং অমর করে রাখে বাংলাভাষীদের হৃদয়ে । দশম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তান । পাকিস্তানের স্বাধীনতা বরণের জন্য প্রথম গানটিই গেয়েছিলো দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া সেই কিশোর । শুধু তাই নয় এরপরও তিনি গান গেয়েছেন অসংখ্য নামকরা চলচিত্রে । সুর করেছেন অমর ভাষা শহীদদের স্মরণে একুশের প্রভাতফেরীর অমর সেই গানের, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি” । এবার নিশ্চয়ই আর চিনতে বাকি নেই কে সেই সুরকার ?
.
হ্যাঁ, সুরকার আলতাফ মাহমুদ ।
.
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমরা সুরকার আলতাফ মাহমুদকে মনে রাখলেও ভুলে গেছি শহীদ আলতাফ মাহমুদকে । বরিশাল জেলার মুলাদী থানার পাতাচর গ্রামের কৃতি সন্তান আলতাফ মাহমুদ (একি গ্রামের আরেক বীর যোদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর) । যুদ্ধকালীন সময়ে অনুপ্রেরণামূলক বিভিন্ন গানের সুর করে যুদ্ধকে আরো বেগবান করার জন্য তিনি খুব গোপনে তা পাঠাতেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে । নিজ বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাবার দেয়ার পাশাপাশি তাদের কাছে চিঠিপত্র ও বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সাহায্য করতেন আলতাফ মাহমুদ । দেশের ভয়ানক পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এতোভাবে সাহায্য করার পরও মনে মনে স্বস্থি পাচ্ছিলেন না আলতাফ মাহমুদ । অবশেষে জুলাই মাসে দুই নং সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে ঢাকার ছাত্র ও যুবকের নিয়ে গঠিত ক্র্যাক প্লাটুনে যোগদান করেন চল্লিশোর্ধ আলতাফ মাহমুদ । যোগদানের সময় তিনি বলেন, যে হাতে এতোদিন তিনি হারমোনিয়াম বাজিয়েছেন, সে হাতে তিনি রাইফেল চালাতেও সক্ষম । ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা যোদ্ধারা ফার্মগেটে পাকিস্তানি সেনাদের চেকপোস্টসহ, যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানিদের মদদদাতা আমেরিকার তথ্যকেন্দ্র, ডিআইটি ভবনে অবস্থিত পাকিস্তান টেলিভিশন কেন্দ্র, ওয়াপদা ভবন, ইলেকট্রিক্যাল স্টেশনে বোমা হামলা চালিয়ে পাকিস্তানের শক্তিশালী কেন্দ্রগুলো গুঁড়িয়ে দেয় । এতোগুলো সফল অপারেশন পর ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধাদের ধরার জন্য পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকারদের আনাগোনা কয়েকগুণ বেড়ে যায় । অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখা নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন তারা । আলতাফ মাহমুদ তখন থাকতেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের নিকটেই । আলতাফ মাহমুদ বলে উঠলেন অস্ত্র গোলাবারুদ তিনি রাখবেন তার বাসায়, পাকিস্তানি সৈন্যরা আন্দাজও করতে পারবে না তাদের ক্যাম্পের কাছে কোনো বাসাতে অস্ত্র মজুদ আছে ।
.
৩০ আগষ্ট ১৯৭১
ভোর ৬ টা
.
রাজারবাগ আউটার সার্কুলার রোডের ৩৭০ নাম্বার বাসা ঘেরাও করলো পাকিস্তানি সৈন্যরা । দ্রুত গতিতে দরজা ভেঙে ঢুকে পড়লো বাড়িতে, চিৎকার করে ডাকতে থাকলো আলতাফ মাহমুদকে । ভেতরের এক রুম থেকে বের হয়ে এসে দৃঢ়তার সাথে নিজের পরিচয় দিলেন আলতাফ মাহমুদ । অস্ত্র কোথায় জিজ্ঞেস করলে তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না বললে পাকিস্তানি এক সেনা রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে তার সামনের দাঁত দুটো ভেঙে দেয় । এরপরও তিনি অস্বীকার করলে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন চিৎকার করে বললো, এক থেকে দশ গোনার মধ্যে তিনি অস্রের কথা না বললে তার চোখের সামনে বাসার সবাইকে গুলি করে হত্যা করে হবে ।
.
১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭
সাত পর্যন্ত গোনার পর আলতাফ মাহমুদ বাগানের লেবু গাছতলায় মজুদ করা অস্ত্রের কথা বললেন । তাকে পেটাতে পেটাতে লেবু গাছতলা পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে এক পাক সেনা বললো, তুই নিজেই মাটি খুঁড়ে অস্ত্র বের করবি । কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করলেন আলতাফ মাহমুদ । মাটি খনন কালীন সময়ে একের পর এক পাক সেনারা তাকে লাথি মারতে থাকে । একসময় তাকে রাইফেলের বাট দিয়েও আঘাত করতে থাকে । বেয়নেটের আঘাতে রক্তাক্ত হয় আলতাফ মাহমুদের মুখশ্রী । মাটি খুঁড়ে অস্ত্র তোলার পরে আলতাফ মাহমুদকে রশি দিয়ে বেঁধে পাক সেনারা তুলে নিয়ে যায় তাদের ক্যাম্পে । যাবার আগে স্ত্রীকে বলে যায় সন্তানদের দিকে যেনো খেয়াল রাখে ।
.
তেজগাঁও সেনা ছাউনীতে নিয়ে আলতাফ মাহমুদকে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয় । বেত, চাবুক, লাঠি দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে বার বার তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, কে কে এই অস্রের সাথে জড়িত । তিনি প্রতিবারই একি উত্তর দেন, কেউ তার সাথে জড়িত নয়, তিনি একাই অস্র এনে লুকিয়ে রেখেছেন । এরপর তার গিঁটে-গিঁটে, কনুইয়ে, হাঁটুতে, কব্জিতে মেরে একি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে পাক সেনারা । এতো নির্যাতনের পরও তিনি একি উত্তরই দেন । পানি চাইলে বুট দিয়ে বুকে, পেটে, মুখে লাথি মারতো হানাদারেরা । মারতে মারতে একসময় জ্ঞান হারিয়ে অচেতন হয়ে গেলে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে এনে আবার নির্যাতন চালাতো । জ্বলন্ত সিগারেটের আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তার শরীরের বিভিন্ন স্থান । মারতে মারতে হাটু ভেঙে দেয়া হয়েছিলো তার । পায়ে দড়ি বেঁধে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে উল্টো করে বেঁধে ফ্যান ছেড়ে দেয়া হয় । উল্টো হয়ে ঝুলতে ঝুলতে ফ্যানের সাথে ঘুরতে থাকা অবস্থায় লাথি,ঘুষি দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করা হয় তার সহযোগীদের নাম তবুও তিনি একবারের জন্যও তার সহযোদ্ধাদের নাম বলেন নি । ৬ সেপ্টেম্বর বদি, রুমি, জুয়েল, আজাদ, হাফিজদের মতো তাকেও হত্যা করা হয় ।
.
“যাদের রক্তে স্বাধীন হয়েছে প্রিয় বাংলাদেশ”
.
সহায়ক গ্রন্থঃ
“দেশটাকে ভালোবেসে-১”
__লে কর্ণেল (অব) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, বীর প্রতীক