রঙের জীবন

দ্বিতীয় সত্তা-২য় পর্ব || অরণ্য ইমতিয়াজ

বুঝলেন ভাই আমি যেদিন প্রথম খুন করি, সেদিন কিন্তু আমার খুনের কোনও ইচ্ছে ছিল না, আর আঘাতটিও আমি খুন করার জন্য করিনি সেদিন। এমনিতে আমার বাবা একটু প্রভাবশালী ছিল, যে কারণে এলাকায় একটু প্রভাব নিয়ে চলতাম, একটু আধটু মারামারি করতাম, বাবার কারণে এলাকায় কেউ কিছু বলতে সাহস পেত না। কিন্তু ওই লাগামহীনতাই আমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ালো।

ওই ছেলের সাথে আমার কোনও শত্রুতা ছিলনা। আমার এক বন্ধুর সাথে কি নিয়ে যেন ঝামেলা হয়েছিল ওর, এতো বছর পর সেই কারনটিও এখন আর মনে নেই হা হা হা। আমি সম্রাট ভাইয়ের দিকে হতবিহ্বল তাকিয়ে থাকি, তার হাতে একজন মানুষ খুন হয়ে যাওয়ার ঘটনা বলছে, অথচ কতো নির্লিপ্ততা তার চোখে মুখে, কতো সহজভাবে বলে যাচ্ছে যেন এটা কোনও ব্যাপারই না। আজ আমি বুঝতে পারছি মানুষ কেন তাকে এতো ভয় পেত, যে মানুষটিকে আমি কখনোই ভয় পাইনি পরিচয় হওয়ার পর থেকে, আজ তার ভয়েই বুকের ভেতর ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে আমার।

সেদিন দুজনের ঝামেলা মীমাংসা করার জন্যই আমি গিয়েছিলাম, কিন্তু ছেলেটি আমাকে চেনার পরেও আমার কথার কোনও গুরুত্ব দিচ্ছিল না। উল্টো বরং আমার সামনেই আমার বন্ধুকে হুমকি দিয়ে বসে। আমার রাগ আবার এমনিতেই একটু বেশী, তখন বয়স অল্প ছিল ওর কথা আমার অহংবোধে চরমভাবে আঘাত করে, আমার সাথে যারা ছিল তারা ছেলেটিকে হালকা মারধোর দেয়, আমি তাকিয়ে দেখতেছি কিন্তু আচমকা আমার যেন কি হয়, সাথে থাকা কিরিচ বসিয়ে দেই ওর পেটে, কিরিচটা ওর কিডনী ভেদ করে ঢুকে যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই সেই যে রক্তের দাগ লেগে যায় আমার হাতে, এখনো মুছতে পারিনি ভাই।

জানেন আমার জীবনে এই একটি খুনের প্রমাণ ছিল পুলিশের কাছে। আর একটি খুনের প্রমাণ পেতে দেইনি পুলিশকে। সিয়াম ভাই মজার কথা শুনেন যে বন্ধুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথম খুন করি, সেই বন্ধুটিও আজ বেঁচে নেই, আমিই ওকে মেরেছি হা হা হা হা। আজ সব বলবো আপনাকে, আমার জীবনের যে কথা কেউ জানে না, তা আপনি জানবেন আজ। আমি এখন শুধু শুনে যাচ্ছি তার কথা, কিছু ভাবতে আর পারছি না এখন। বারবার শুধু একটি কথাই মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে, যে লোক কোনও প্রমাণ ছাড়া একের পর এক খুন করে গেছে, সে তার সব আমাকে বলে এই প্রাণহীন বালুচর থেকে আমাকে যেতে দিবে???

ভাই নিন সিগারেট খান,সিগারেট নিতে গিয়ে দেখি প্রচন্ড বেগে হাত কাঁপছে।আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আবার হেসে উঠেন সম্রাট ভাই। হা হা হা, আরে ভাই জীবন আর কয়দিনের বলুন,আজ আছি তো কাল নেই,পুরুষ মানুষ বুকে সাহস আনুন, নিন সিগারেট খান,কে জানে এটাই হয়তো আপনার শেষ সিগারেট হা হা হা।কোনওক্রমে সিগারেট হাতে নেই আমি,কিন্তু হাত উপরে আর তুলতে পারছিলাম না। সম্রাট ভাই এক পলক দেখে আবার তার কথা শুরু করেন।

যে কথা বলছিলাম আপনাকে, ছেলেটিকে তো ওখানে রেখে আমরা চারজন পালিয়ে আসলাম। কিন্তু কেউ না দেখলেও প্রমাণ ঠিকই রেখে আসলাম। যে জায়গায় মেরে ছিলাম সেখান থেকে ও হাসপাতালে যেতে পারতো না, আর সে শক্তিও ছিলনা কিন্তু ও মৃত্যুর আগে আমার বন্ধু তিনজনের নাম লিখে যায় কিন্তু আমার নামের এক অক্ষর লেখার পরেই সে মারা যায়।ঝামেলা বাধে এখানেই, পুলিশ তো ওই তিনজনকে ধরে ফেলে। যে বন্ধুর জন্য ঘটনার সূত্রপাত সেই বাঁচার জন্য আমার নাম প্রকাশ করে দেয় যে ওরা মারেনি আর মারতে চায়নি, আমিই সব করেছি। পুলিশ আমার বাসায় আসার আগেই আমার বাবার কাছে সব খবর চলে আসে, আর আমি পালিয়ে যাই। অবশ্য দুদিন পরই ফিরে আসি আবার বাসায়। কারণ এই দুদিনে বাবা সব ঠিক করে ফেলেন, চার্জশীট থেকে আমার নাম বাদ পরে যায়, মূলত আমরা চারজনই মুক্তি পেয়ে যাই। কি থেকে কি করেন সেটা বাবাই ভালো জানেন, আমি শুধু এটা জানি প্রচুর টাকা খরচ হয় বাবার। কিন্তু আমার রাগ থেকে যায় ওই বন্ধুর প্রতি যে আমার নাম প্রকাশ করে দেয়।

স্বিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি ওকে মেরে ফেলব, যে বাঁচার জন্য আমাকে বিপদে ফেলে তাকে বাঁচিয়ে রাখবো না। তবে এবার কোনও প্রমাণ রাখবো না। পরিকল্পণা করে ফেলি সবটা কি করে কি করবো। আমরা একই এলাকার আর প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অব্দি একসাথেই থাকি, তাই কাউকে না জানিয়ে ওকে কোথাও নিয়ে যাওয়া সমস্যা ছিল না আমার জন্য। আর আমরা এর আগে যে একসাথে কোথাও যায়নি এমনটাও না।একদিন সকালে আড্ডা দিয়ে দুপুরে বাসায় যাওয়ার সময় ওরে বললাম সন্ধ্যায় শ্মশানঘাট ঘাটের ব্রীজে আসতে এক জায়গায় যাবো। ও সবসময় ওর বাইক নিয়ে বের হতো, সেদিন বাইক রেখেই আসতে বলি। আপনি তো জানেন সন্ধ্যার পর ওই জায়গাটা একদম নির্জন হয়ে যায়।তো ও আসার পর আমার বাইকে করে ওকে নিয়ে আসি এখানে।

আসলে এখানে না, ওইযে দেখছেন একটু দূরে বনের মতো দেখা যায় ওখানে। আসলে ওটা বন না, তবে বেশ কিছু বড় গাছ থাকার কারণে দূর থেকে বনের মতোই দেখা যায়। এর আগেও আমরা দুজনে এ জায়গায় এসেছি তাই সামান্য সন্দেহ ও করেনি। আমি আপনি যেমন পাশাপাশি বসে আছি এমন করেই এক গাছের নিচে বসে আমরা। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পর কোনও কিছু বুঝতে না দিয়েই ওর গলায় ছুরি বসিয়ে দেই। ও কোনও কথা বলার সুযোগ পায় না। জানেন সেই সময় ওর চোখে চোখ পড়ে গিয়েছিল আমার। সেই দুই চোখ এখনো ভুলতে পারিনি আমি।ও মরে যাওয়ার পরে ওখানেই একটা বড় গর্ত করি। সেই গর্তেই ওকে ফেলে মাটিচাপা দেই। আমি জানতাম এখানে কেউ আসেনা। আর এই গর্তটাও কেউ দেখবে না।এখন ওই গর্তের কথা কেউ জানতে পারেনি, আর এতো বছর পর তো ওখানে ঘাস লতাপাতা গজিয়ে এমন হয়েছে যে কিছুই আর বুঝার উপায় নেই। সেদিন মাটিচাপা দিয়ে ফিরে আসার পথে আমার পা যেন চলছিল না, একটুও জোড় পাচ্ছিলাম না পা দুটিতে। বারবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি পেছন থেকে ডেকে উঠবে আর টেনে ধরবে।

আমার নিশ্বাস বন্ধ বুঝি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তখন, এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম সম্রাট ভাইয়ের দিকে। এ আমি কার সাথে মিশেছি এতোদিন?? নিজের হাতে করা খুনের কথা কি অবলীলায় বলে যাচ্ছে।খুব পানি পিপাসা পেয়েছে আমার, একটু পানি পেলে ভালো হতো। পানির বোতলটা পাশেই ছিল কিন্তু সেটা তুলে খাওয়ার ক্ষমতা আমার ছিলনা তখন।
কি ভাই দেখতে যাবেন ওখানে? যেখানে আমার বন্ধুকে মাটিচাপা দিয়ে রেখেছি। কথা বলতে গিয়ে দেখি কথা বলতে পারছি না। কোনওমতে মাথা নেড়ে জানাই না যাবো না।

চলবে——>